৭১ হাজার ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসায় খরচ ২৭৮ কোটি টাকা
২৯ আগস্ট ২০১৯চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রুগির সংখ্যা দাঁড়াবে ৭১ হাজার জন, আর চিকিৎসাবাবদ এদের ২৭৮ কোটি টাকা খরচ হবে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ তার ছয়জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই গবেষণা করছেন৷ ঢাকার হাসপাতালগুলো থেকে ডেঙ্গু রুগিদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন তারা৷
অধ্যাপক হামিদ বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে তাদের গবেষণার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন৷ তিনি বলেন,গবেষণাটা এখনো চলছে৷ হাসপাতালে যারা ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছেন তাদের কত খরচ হয়েছে সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে৷ আমাদের হিসেবে খরচটা খুব বেশি না৷ তবে সব ধরনের খরচ হিসেব করলে এই খরচ বড় হবে৷
রুগির প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, খাবার ও হাসপাতালে আসার খরচ; দুইজন অ্যাটেনডেন্টের কর্মঘণ্টা এবং যারা মারা গেছেন মাথাপিছু আয় ধরে তাদের অর্থনৈতিক ভ্যালু অ্যাড করে এই খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে৷
সরকারি হিসেবের বাইরে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের এই হিসেবের মধ্যে আনা হয়নি৷ এছাড়া হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, জ্বর হওয়ার পর আতঙ্কিত হয়ে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করিয়েছেন, মশা মারার ওষুধ কিনেছেন এবং ডেঙ্গু আতঙ্কে যাদের মানসিক ট্রমা হয়েছে তাদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার খরচও এই হিসেবের মধ্যে আনা হয়নি৷
অধ্যাপক হামিদ বলছেন, এবার ডেঙ্গুতে ৩০ বছরের কম বয়সীরা বেশি মারা গেছে৷ সরকারি হিসেবে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ আগস্ট ৫১ হাজার ৫০০ জন ডেঙ্গু রুগি হাসপাতালে ভর্তি হয়৷ ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোকে একটি শ্রেণিতে রেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ‘এ' এবং ‘বি' ক্যাটাগরিতে ভাগ করে খরচের চিত্র তুলে আনা হয়৷
এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের ছয় থেক আট দিন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে৷ সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজার ডেঙ্গু রুগি ভর্তি হয়েছেন, এদের গড়ে খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করে৷
‘এ' ক্যাটাগরির বেসরকারি হাসাপাতালে একেকজন ডেঙ্গু রুগির খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা৷ আর ‘বি' ক্যাটাগরির বেসরকারি হাসপাতাল এই খরচ ছিল সাড়ে ৫৩ হাজার টাকা৷ এই হিসেবে গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত মোট খরচ দাঁড়িয়েছে ২০৪ কোটি টাকা৷
অধ্যাপক হামিদ বলেন, এবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদন গড়ে দেড় হাজার রুগি হাসপাতালে ভর্তি হয়৷ এই হার বিবেচনা করলে আগস্টের শেষে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রুগির সংখ্যা দাঁড়াবে ৭১ হাজার, আর খরচ ঠেকবে ২৭৮ কোটি টাকায়৷
চাই মহাপরিকল্পনা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গু বাড়ছে মত দিয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হামিদ বলেন, আগে টানা বৃষ্টি হত, সবকিছু ধূয়ে নিয়ে যেত৷ এখন দেখা যায় একটু বৃষ্টি হয়ে আবার তিনদিন বৃষ্টি নেই৷ ফলে পানি জমে থাকে, আর এই পরিস্কার পানিতেই এডিস মশা হচ্ছে৷
‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের এই ধারা অব্যাহত থাকবে৷ এজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে৷ ডেঙ্গু কেন হচ্ছে এবং এটা নিয়ন্ত্রণে পারিবারিকভাবে কি করতে পারি, সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে৷ ডেঙ্গু কেন হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে এটার সায়েন্টেফিক অ্যানালাইসিস আছে আরো অ্যানালাইসিস করে যেসব কারণে ডেঙ্গু হচ্ছে সেখানে হাত দিতে হবে৷ ''
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনমূলক কার্যক্রম নেওয়ার সুপারিশ রেখে হামিদ বলেন, ‘‘আমরা প্রচুর পলিথিন ব্যবহার করছি, ময়লা আবর্জনা ঠিকমত পরিস্কার করা হয় না৷ এ বিষয়ে সামাজিকভাবে সচেতন করতে হবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে৷
‘‘সরকারি স্থাপনা যেমন- থানায় পুরাতন গাড়ি বছরের পর বছর জমে আছে, হাসপাতালে বহু পুরানো জিনিসপত্র জমা হয়ে থাকে, সেখান থেকে মশা ছড়াতে পারে৷ কনস্ট্রাকশন খাতেও এটা হচ্ছে৷''
হামিদের ভাষ্য, ‘‘সব কিছুকে নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে৷ ডেঙ্গু কেন হচ্ছে, কীভাবে এর বিস্তার হচ্ছে, সামনে এই পরিস্থিতি কোথায় পৌঁছাতে পারে- এসব বিষয় মাস্টার প্ল্যানে থাকতে হবে, সেখানে বিশেষজ্ঞদের মতামতও থাকতে হবে৷ এটা না করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না৷''
এবার ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রুগির সংখ্যা বাড়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে অধ্যাপক হামিদ বলেন, ‘‘সেখানে (মফস্বলে) ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই৷ ফলে সেখানকার রুগিদের অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ার পর তাদের ঢাকায় আনা হচ্ছে, এতে তাদের খরচ বেশি হচ্ছে৷
‘‘ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ঢাকায় বাইরে ছড়িয়ে দিতে হবে, সেখানে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে৷ বিশেষ করে রুগির প্লাটিলেট কমে যখন ২০ হাজারের কাছাকাছি চলে আসে তখন সব রুগিকে কিন্তু ওখানেও রক্ত দেওয়া যেত, এটা না করে ওইসব রুগিকে ঢাকায় আনা হচ্ছে৷ ফলে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রুগিদের জায়গা হচ্ছে না৷''
ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবারের মত ব্যাপক আকার ধারন করলে তা কীভাবে ম্যানেজ করা হবে সেটিও মাস্টারপ্ল্যানে থাকতে হবে৷ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো, বিকল্প ব্যবস্থা করার বিষয়ও মাস্টার প্ল্যানে থাকতে হবে৷
অধ্যাপক হামিদ বলেন, পুরো তথ্য-উপত্ত সংগ্রহ করে রিপোর্ট চূড়ান্ত করতে এক মাস সময় লাগবে৷ এরপর একটি কর্মশালার আয়োজন করা হবে৷ প্রতিবদনটি জার্নালে প্রকাশের চেষ্টা করা হবে এবং সরকারের বিভিন্ন অথরিটিকে তা রিপোর্ট আকারে দেওয়া হবে৷
শহীদুল ইসলাম