ডেনমার্কের ‘আদর্শ’ দ্বীপের আকর্ষণ
১৮ জুন ২০২০প্রকৃতির প্রতি আন্তরিক ভালবাসা থাকলেই বাল্টিক সাগরের উপর ডেনমার্কের সামসো দ্বীপে পাকাপাকি বাসা বাঁধা যায়৷ নীরব এই দ্বীপের পাহাড়ি অথচ মসৃণ নিসর্গ আইস এজ বা তুষার যুগের নিদর্শন৷ তবে টিনা ও তাঁর স্বামী বেন বছর তিনেক আগে শুধু এই সব কারণে কোপেনহেগেন ও আরহুস শহরের ব্যস্ততা ছেড়ে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেন নি৷
তাঁরা আসলে এক পরীক্ষার সময় এই দ্বীপে উপস্থিত থাকতে চান৷ সেখানকার মানুষ পৃথিবীকে বাঁচাতে সেই পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷ টিনা মনে করিয়ে দেন, ‘‘টেকসই জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সামসো দ্বীপ একেবারে প্রথম স্থানে রয়েছে৷ সেটা আমাদের কাছে জরুরি৷ বিশ বছর আগে এখানে যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা আমাদের প্রেরণা জোগায়৷ আমরাও তার অংশ হতে চাই৷’’
দীর্ঘকালের উদ্যোগ
প্রায় ৩,৫০০ মানুষের এই দ্বীপটি ঘুরে দেখলে প্রথমে শুধু অতি মনোরম নিসর্গ চোখে পড়ে৷ ডেনমার্কের অন্য দ্বীপগুলির সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য টের পাওয়া যায় না৷ ভালো করে লক্ষ্য করলে প্রথম প্রজন্মের অসংখ্য উইন্ডমিল এবং টাউন হলের সামনে বিশাল সৌর প্যানেল চোখে পড়বে৷ ইয়োর্গেন ট্রানব্যার্গের মতো চাষি এমন উদ্যোগের পথিকৃৎ৷ বিশ বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি দ্বীপের বাসিন্দাদের নিয়ে প্রথম বায়ুচালিত জ্বালানী কেন্দ্রের পার্ক গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইয়োর্গেন বলেন, ‘‘সে সময় যখন আমার প্রথম উইন্ডমিলের জন্য এক কোটি বিশ লাখ ক্রাউন বিনিয়োগ করলাম, তখন বেশ সমস্যা হয়েছিল৷ ব্যাংক বদল করে অনেক ঋণ নিতে হয়েছিল৷ শুধু ‘ধরিত্রী মা’-র জন্য কেউ এমন করে না৷’’
সে সময়ে ডেনমার্কের মূল ভূখন্ড থেকে তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমাতে তিনি সহায়তা করেছিলেন৷ আজ সেই উদ্যোগ থেকে যথেষ্ট মুনাফা হচ্ছে৷ শুধু বায়ু ও সৌরশক্তি নয়, গ্রীষ্মে যে খড় পাওয়া যায়, তা দিয়ে শীতকালে ঘর গরম রাখতে পারেন দ্বীপের বাসিন্দারা৷ ইয়োর্গেন ট্রানব্যার্গ বলেন, ‘‘এই খড় এখানেই গজায়৷ বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্ত থেকে পেট্রোলিয়াম আসে৷ সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো বসন্তকালে আবার খড় গজায়৷ দারুণ সমাধান, তাই না?’’
বহুমুখী উদ্যোগ
ট্রানব্যার্গের ‘স্মার্ট' খড় ছোট এক চুল্লিতে বাড়িঘর গরম রাখার জন্য উত্তাপ সৃষ্টি করে৷ ফলে সামসো দ্বীপ ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে৷ কার্বন নির্গমন পুরোপুরি বন্ধ করার লক্ষ্যও হাসিল করেছে স্থানীয় সমাজ৷ এলসেবেথ হোখ সেই পথ দেখাচ্ছেন৷ প্রতিদিন সকালে তিনি তাঁর ইলেকট্রিক গাড়ির প্লাগ খোলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ছাদের উপরেই যাকে বলে পেট্রোল পাম্প বসানো আছে৷ সৌরশক্তি দিয়েই গাড়ি চার্জ করা হয়৷ ব্যাপারটা এত সহজ৷’’
সাত বছর আগেই দ্বীপের কর্তৃপক্ষ শুধু বিদ্যুতচালিত সরকারি গাড়ি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ডিজেলচালিত গাড়ির তুলনায় ব্যয় প্রায় অর্ধেক কমে গেছে৷ সেইসঙ্গে নির্গমনও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে৷
দিনে দুই-তিনবার এলসেবেথ গ্রুড্রুন হল্মের দেখাশোনা করতে আসেন৷ ৮৭ বছরের এই বৃদ্ধা প্রথমদিকে গাড়ির শব্দ না পেয়ে একটু বিরক্ত হতেন৷ পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানীর কারণে শব্দও দূর হয়েছে৷
সার্বিক সমন্বয়ই সাফল্যের চাবিকাঠি
এনার্জি অ্যাকাডেমিতে দ্বীপের সব ছোট প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয় করা হয়৷ ১৯৯৭ সালে এই প্রতিষ্ঠান ডেনমার্কের সরকারের কাছ থেকে সামসো দ্বীপে ‘বিপ্লব' ঘটানোর দায়িত্ব পেয়েছিল৷ অ্যাকাডেমির সদস্য স্যোরেন হেরমানসেন বলেন, ‘‘আসল কথা হলো, কার্বন নির্গমন কমাতে আমরা সফল হয়েছি৷ প্রথমে শুধু সব চাহিদা মেটানো গেছে৷ আর এখন আমরা চাহিদার তুলনায় বেশি জ্বালানী উৎপাদন করছি৷ গোটা বিশ্বই সেই পথে অগ্রসর হতে চায়৷’’
বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে অতিথিরা উপহার নিয়ে এসেছেন৷ বাল্টিক সাগরের উপর ছোট্ট এই দ্বীপ থেকে সব প্রতিনিধিদল প্রেরণা পেয়েছে৷
বেন আর টিনাও এই উদ্যোগে অবদান রাখতে চান৷ দ্বীপের অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁরা জ্বালানী সাশ্রয়ের আরও পদ্ধতি সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করছেন৷ ২০২০ সালেই তাঁদের সর্বশেষ প্রকল্প শুরু হবার কথা৷ এর আওতায় ডেনমার্কের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যাত্রীবাহী ফেরি পরিষেবা শুরু হবে৷ অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হালকা এই যান চালাতে খুব কম ডিজেলের প্রয়োজন হবে৷ টিনা কিয়ির বলেন, ‘‘পুরোপুরি বিদ্যুতচালিত যান হলে খুব ভালো হতো৷ কিন্তু এমন ব্যাটারি এখনো বিশাল বড় ও খুবই দামী৷ ফলে আপোশ হিসেবে ভবিষ্যতে সম্ভব হলেই আমরা ইঞ্জিন বদলে দেবো৷’’
বিশ্বের রক্ষাকর্তা হতে হলে কখনো কখনো বাস্তববুদ্ধি প্রয়োগ করতেই হয়৷
ক্রিস্টোফর সেল/এসবি
২০১৮ সালের মার্চের ছবিঘরটি দেখুন...