দলিতদের ডাকা ভারত বনধে জ্বলেছে গোটা দেশ
৩ এপ্রিল ২০১৮সরকার দলিত আইনে রদবদল ঠেকাতে আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানালে শীর্ষ আদালত ঐ রায়ে স্থগিতাদেশ দেননি৷ দলিত ইস্যুতে মঙ্গলবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সংসদের অধিবেশন৷
তপশিলি জাতি-উপজাতিদের ওপর নির্যাতন রোধ আইন লঘু করতে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন গত ২০শে মার্চ তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে দলিত সমাজ৷ কারণ, তাঁরা মনে করেন, এর ফলে দলিতদের ওপর অত্যাচার আরও বাড়বে৷ এই আইন থাকা সত্বেও দলিতদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য কমেনি৷ আইনের যথাযথ প্রয়োগে এখনও রয়েছে যথেষ্ট গাফিলতি৷ সমাজে এখনও রয়েছে ‘অস্পৃশ্যতা'র মতো অভিশাপ৷ দলিতরা অন্যদের মতো প্রথাগতভাবে বিয়েতে ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারবে না৷ পুলিশ প্রশাসন এইসব বিষয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকায় দোষী সাব্যস্ত হয় অতি নগণ্য– এমনটাই অভিযোগ দলিত সম্প্রদায়ের৷ দলিতদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়লেও তাঁরা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে৷ তাই এই সংশোধন দলিত স্বার্থবিরোধী৷
এর প্রতিবাদে বিভিন্ন দলিত সংগঠনভারত বনধের ডাক দেয় গতকাল৷ অগ্রণী দলিত সংগঠন ভীম সেনার নীল পতাকার নীচে শামিল হয় রাষ্ট্রীয় সেবাদল, ন্যাশনাল দলিত মুভমেন্ট ফর জাস্টিস, ভারিপ বহুজন মহাসংঘের মতো বেশ কয়েকটি দলিত সংগঠন৷ সেই বনধের জেরে বিহার থেকে নিয়ে গোটা উত্তর-মধ্য ভারতে জ্বলে ওঠে হিংসার আগুণ৷ পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, রেল ও সড়ক অবরোধ, সরকারি সম্পত্তি ভাংচুর, পুলিশের ওপর পাথরবৃষ্টি, পুলিশের পালটা গুলি, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, তারমধ্যে পুলিশের গাড়িও আছে৷ ইন্টারনেট পরিষেবা বেশ কিছু এলাকায় বন্ধ রাখা হয়, যাতে গুজব ছড়িয়ে জনরোষে উসকানি না দেয়া যায়৷ মোটকথা, থমকে যায় গোটা দেশের স্বাভাবিক জনজীবন৷ হিংসার জেরে মারা যায় নয়জন দলিত৷ আহত হয় পাঁচজন পুলিশসহ ২৬ জন৷ এরমধ্যে কয়েকজনের আঘাত গুরুতর৷ মধ্যপ্রদেশে ছয়জন, রাজস্থানে একজন এবং উত্তরপ্রদেশে দুইজন৷ রাজস্থানের আলওয়ারে এবং মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র ও মোরেনায় জারি করা হয় আংশিক কারফিউ৷ খোদ রাজধানি দিল্লিতেও এই বিক্ষোভের আঁচ বেশ ভালোই পড়ে৷ যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়৷ সবথেকে বেশি নাজেহাল হতে হয় বোর্ডের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীদের৷
দলিত বিক্ষোভ নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে যথারীতি শুরু হয় সরকার ও বিরোধী দলগুলির চাপানউতোর৷ শুরু হয় দোষারোপ ও পালটা দোষারোপের পালা৷ তুমুল হৈ-হট্টগোলে সংসদের উভয়সভার অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায়৷ এই আইনে রদবদল করার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে পরিস্থিতি যে এইভাবে ঘোরালো হয়ে উঠবে, সহিংস হয়ে উঠবে সেটা সরকার আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি৷
এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক উদয়ন বন্দোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, প্রশাসনের একটা দায়িত্ব তো রয়েইছে৷ প্রথম থেকেই প্রশাসন যে-কোনো মিছিল কড়া হাতে প্রতিহত করার চেষ্টা করতো, তাহলে বিক্ষোভ মিছিল এতটা বিশৃঙ্খলার দিকে গড়াতো না৷ কিন্তু প্রশাসন প্রথম দিকে কিছুটা ঢিলেমি দেয় বলেই পরিস্থিতি অনেক সময় হাতের বাইরে চলে যায়৷ দলিতদের সহিংসতায় প্রশাসনিক দুর্বলতাই ফুটে ওঠে৷ সাধারণ মানুষের মিছিল যে ধ্বংসাত্মক দিকে চলে যায়, তাতে প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতাই ফুটে ওঠে৷ অধ্যাপক বন্দোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে আরও বললেন, ‘‘আসলে যে কারণে আন্দোলন হচ্ছে, তা সে রামনবমী হোক বা দলিত ইস্যু হোক, সেটা যদি নৈরাজ্যের দিকে এগোতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সরকারের প্রতি আস্থা নেই৷ আগে আস্থা অর্জন, পরে দমন৷ তবে হ্যাঁ, সব মিছিলেই কিছু কিছু সমাজ-বিরোধী ঢুকে পড়ে৷ সেটার দায় যারা আন্দোলন করছে তাঁদের যেমন, তেমনি প্রসাসনেরও৷ সমাজ-বিরোধীদের চিহ্নিত করতে হবে৷ তাঁদের সরাতে হবে৷
জনরোষের দিকে তাকিয়ে গতকাল মঙ্গলবারেই কেন্দ্রের মোদী সরকার আদালতের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করতে আদালতে আর্জি জানিয়ে বলেছে, এই রায়ের ফলে দলিত নিপীড়ন প্রতিরোধ আইন সম্পর্কে লোকেদের ভয়ভীতি কমে যাবে৷ দলিতদের ওপর অত্যাচার আরও বাড়বে৷ কী ধরনের রদবদল করতে চেয়েছেন শীর্ষ আদালত ? আদালত মনে করেন, তপশিলি জাতি-উপজাতিদের উপর অত্যাচার আটকাতে যে আইন রয়েছে, তার অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ তাই আদালতের রায়, সরকারি কর্মচারিদের তপশিলি জাতি ও জনজাতির মানুষদের হেনস্থা করার অভিযোগে তড়িঘড়ি দায়ের করা যাবে না এবং সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা যাবে না৷ গ্রেপ্তার করতে হলে নিয়োগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে৷ আর সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে পুলিশের ডিএসপি পদমর্যাদার কোনো অফিসারের অনুমতি লাগবে৷ মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট তাঁর রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেন৷ পরবর্তি শুনানি আগামী দিন দশেকের মধ্যে৷
পাশাপাশি দলিত ইস্যু নিয়ে রাজনীতির জলঘোলা হচ্ছে৷ বিরোধীদের মতে, সরকার আগে কেন দলিত হেনস্থা প্রতিরোধক আইন লঘু করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে আদালতে যায়নি৷ দলিতদের প্রতিক্রিয়া দেখে এখন সরকারের টনক নড়েছে৷ কারণ, আগামী বছর সাধারণ নির্বাচন৷ ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ২০ কোটি দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত৷ তাঁদের ভোট হারাবার ভয়ে মোদী সরকার রাতারাতি দলিত দরদি হতে চাইছে৷ সরকারের তরফে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী রবিশংকরের মন্তব্য, কংগ্রেস শাসনে দলিত সম্প্রদায়ের সর্বাধিনায়ক বাবা সাহেব আম্বেদকরকে উপযুক্ত সম্মানটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয়নি৷ সেই কংগ্রেসের মুখে দলিতপ্রীতি বেমানান৷