ধর্ম, জাতপাতের সহিংসতা বাড়ছে
২১ জুলাই ২০১৮চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভারতে ১০০টিরও বেশি ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষজনিত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে যাকে বলে ‘হেট ক্রাইম'৷ সবথেকে বেশি হয় বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তর প্রদেশে এই ধরনের ১৮টি ঘটনা ঘটেছে৷ তারপর মোদী রাজ্য গুজরাটে ১৩টি৷ এছাড়া রাজস্থানে ৮টি আর বিহারে ঘটেছে ৭টি৷ গত বছর এই সংখ্যাটা ছিল দুশ'র মতো৷ এই তো সমীক্ষা চলাকালীন গত মাসেই উত্তরপ্রদেশের হাপুর শহরে মোহাম্মদ কাশিম নামে এক মুসলিম গরু জবাই করেছে সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়৷ একই সন্দেহে ২০১৫ সালে উত্তরপ্রদেশের দাদরি এলাকায় ঘরে গরুর মাংস রাখার অপরাধে মোহাম্মদ আখলাখকে পিটিয়ে মারার ঘটনার পর মানবাধিকার সংস্থা এই সমীক্ষা শুরু করে৷ তখন থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ৬০৩টি হামলা চালানোর ঘটনা ঘটে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘বিদ্বেষ থামাও' নামে এই সমীক্ষা শুরু করে৷ সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে ৬৭টি দলিত ও আদিবাসী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ এর মধ্যে গো-সন্ত্রাস এবং অনার কিলিং সবথেকে বেশি৷ জাতিভেদ এবং ধর্মীয় হিংসার কেন্দ্রভূমি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা. এবং দক্ষিণী রাজ্য কেরালা৷
সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, বুলন্দশায়েরের এক গ্রাম পঞ্চায়েত ৪৪ বছর বয়সি এক ব্যক্তিকে ডেকে পাঠিয়ে মারধর করে এবং তারপর নিজের থুথু নিজেকে চাটতে বাধ্য করে৷ তাঁর অপরাধ, তাঁর ছেলে অন্য জাতের মেয়েকে বিয়ে করেছে৷ কেরালায় এক খ্রিস্টান যুবক এক মুসলিম তরুণীকে বিয়ে করার পর তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারকে খুন করার হুমকি দেওয়া হয়৷ এই হুমকি লাগাতার চলছে৷ তবে ঐ তরুণ-তরুণী নিজেদের ধর্ম পরিত্যাগ করেনি৷ দলিতদের ওপর হিংসার কারণ যথেষ্ট মর্মান্তিক৷ দলিতরা ঘোড়ায় চাপলে সেটা অপরাধ৷ সেই অপরাধে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়৷ দলিত মহিলারা হামেশাই গণধর্ষণের শিকার হয় এবং জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নজিরও কম নেই৷
অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়েছে, অন্যান্য অপরাধ থেকে হেট ক্রাইমকে আলাদা গণ্য করা দরকার৷ এর পেছনে আছে জাতপাত ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক মানসিকতা৷ এর তদন্ত ও শাস্তিও হওয়া উচিত আলাদাভাবে৷ প্রচলিত আইনে সাধারণত হেট ক্রাইমকে পৃথক অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়৷ এই প্রসঙ্গে এখন সরব হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বেঞ্চের রায়, গণপ্রহারকে পৃথক আইনি অপরাধ গণ্য করে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক৷
কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত সংসদে বিশেষ আইন আনা৷ গণপ্রহার, গণহিংসাকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না৷ কখনো কখনো ভুয়া খবরও অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়৷ জনতাকে হিংসায় উন্মত্ত করে তোলে৷ তাই মোদী সরকারকে গো-সন্ত্রাস বা গণপিটুনির মতো অপরাধ দমনের দায়িত্ব নিতে হবে৷ দায়িত্ব নিতে হবে হেট-ক্রাইম এবং তথাকথিত অনার-কিলিং দমনের৷ গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে বার্তা দিয়েছে মোদী সরকারকে৷ পাশাপাশি রাজ্য সরকারগুলির জন্যও একগুচ্ছ নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কেউই এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না৷ এড়াতে পারে না সুশীল সমাজও৷ সমাজে ভেদাভেদ সৃষ্টির অভিযোগে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশকে এফআইআর করতেই হবে৷ প্রতিটি জেলায় পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট স্তরের একজন অফিসারের উপর থাকবে ধর্ম ও জাতপাত সংক্রান্ত অপরাধ রোখার দায়িত্ব৷ শীর্ষ আদালতের নির্দেশ পুলিশ-প্রশাসনের কাজে গাফিলতি দেখা গেলে কড়া বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এইসব মামলার বিচার হবে ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্টে৷ নির্যাতিতদের আইনি সাহায্য, মেডিকেল সুবিধা, ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তা দিতে হবে৷
দক্ষিণ এশিয়া মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলি এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি, গোরক্ষার নামে যাঁরা হামলা চালালো, পুলিশ তাঁদের না ধরে যাঁরা হামলার শিকার, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করলো৷ এই পরিবেশে যখন আইনের শাসন ভেঙ্গে পড়ে, তখন একটা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এই ধরনের সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়৷ তাই সরকারকে প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে এই পরিবেশ তৈরির জন্য কারা দায়ী৷ কড়া শাস্তি দেওয়া হলে এটা বাড়তো না৷ অনেক সময়ে এটা সংগঠিতভাবে হয়৷ কড়া আইন প্রণয়ন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষি গাঙ্গুলির বক্তব্য, নতুন আইন তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন তার প্রয়োগ ঠিকভাবে হবে৷ এখন তো আমরা দেখছি, চলতি আইনে যেটুকু হতে পারে তা-ও করা হয় না৷ এই তো দেখুন না, কয়েকদিন আগে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী স্বামী অগ্নিবেশকে বিজেপি শাসিত ঝাড়খন্ডে কিভাবে মারধর করা হলো৷ সরকার বলছে, যারা এই কাজ করেছে, তারা আমাদের লোক নয়৷ আইনের শাসন যদি না থাকে, তাহলে নতুন আইন বানিয়ে লাভ কী? আবার এটাও ঠিক, সবক্ষেত্রে শুধু পুলিশকে দায়ী করলেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায় না৷ পুলিশ বলে, আমরা কী করবো, উপরতলা থেকে চাপ আসে, অ্যাকশন নিতে পারি না৷ অনেক সময়ে পুলিশদের মধ্যেও একটা ধারণা কাজ করে যে, রাজনৈতিক নেতারা যখন কম-বেশি জড়িত, তখন দায়িত্বটা দেশের৷''
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? মন্তব্য লিখুন, নীচের ঘরে৷