ফসলের মাঠে কেন আগুন দিচ্ছে কৃষক?
১৪ মে ২০১৯এরকমই আরেক কৃষক আব্দুল মালেক৷ তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার পাইকড়ার বানকিনা গ্রামে৷ ৫৬ শতক জমিতে ধান চাষ করেছিলেন৷ কিন্তু ধান কাটার আগেই ১২ মে তিনি তাঁর ফসলের ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দেন৷ ধান কাটার জন্য মজুরের পারিশ্রমিক দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ধান চাষ করতে খরচ হয় কমপক্ষে ১৪ হাজার টাকা৷ ধান পাওয়া যায় ১৫-১৬ মন৷ ধানের মন এখন ৫শ' সাড়ে ৫শ' টাকা৷ ফলে ১৬ হাজার টাকা খরচ করে যে ধান হয়, তার দাম কোনোভাবেই ১০ হাজার টাকার বেশি নয়৷ তাহলে আমরা পোষাবো কিভাবে?''
তিনি একটা হিসাবও দেন৷ এক বিঘা জমি চাষের খরচ কমপক্ষে ১০০ টাকা, বীজ ও রোপণের খরচ ২৫০০, প্রথম দফায় সার ১৫০০, দ্বিতীয় দফায় সার, কীটশাক নিড়ানি ২০০০, ফসল কাটতে ৬ জন দিনমজুরের জন্য ৬০০০ টাকা, এরসঙ্গে আছে দিনমজুরদের খাওয়ানোর খরচ৷
এই কৃষক নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের শ্রম এবং নিজের জমি হওয়ায় জমির ভাড়ার হিসেব এখানে দেননি৷ তাহলে খরচের হিসাবটি আরো বাড়বে৷
তিনি জানান, ‘‘এখন এই ধান কাটার মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা বেশি৷ তাঁদের মজুরিও বেশি৷ ৯শ' থেকে এক হাজার টাকার নীচে কোনো মজুর পাওয়া যায় না৷ আর এক কিঘা জমির ধান কাটতে ৬-৭ জন মজুর লাগে৷ একজন দিনে সর্বোচ্চ ৫ শতক জমির ধান কাটতে পারেন৷''
এদিকে মঙ্গলবার টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার আরো একজন কৃষক তাঁর ধানের ক্ষেতে আগুন দিয়েছেন৷ তাঁর নাম নজরুল ইসলাম৷ তিনি একজন সম্পন্ন কৃষক৷ কিন্তু এবার ধানের শীষ আসার পর চিটা রোগে আক্রান্ত হয় ফসল৷ ফলে বিঘা প্রতি ৩-৪ মন ধান হয়নি৷ এই ধান কাটতে প্রতিদিন এক হাজার টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এমনিতেই আমার ফসল কম হয়েছে, তার ওপর ধানের দাম অনেক কম৷ ফলে একজন মজুরকে এক হাজার টাকা করে দিয়ে এই ধান কাটালে আমার লোকসান আরো বাড়বে৷ তাই ফসলের মাঠে দুঃখে আগুন দিয়েছি৷ এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই৷''
এবার সরকার প্রতিমন ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ১০৪০ টাকা৷ প্রতি কেজি ২৬ টাকা৷ কিন্তু বাস্তবে বাজারে সাড়ে ৫শ' টাকার বেশিতে কোথাও ধান বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা৷ তাতে প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা৷ এটা সর্বোচ্চ দর৷ আর সরকারের হিসাবেই প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা ৩০ পয়সা৷ সরকারের হিসাব মেনে নিলেও প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করে কৃষককে ১১ টাকা ৫০ পয়সারও বেশি লোকসান গুনতে হয়৷
সরকার যে ধানের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই দামে কৃষকের কাছ থেকে সারাদেশে খাদ্য কর্মকর্তাদের ধান কেনার কথা৷ কিন্তু কৃষক যত ধান বেচতে চায়, তত ধান কেনা হয় না৷ আর কৃষকরা সরসরি বেচতেও পারেন না৷
এবারের বোরো মৌসুমে সরকার সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আগামী ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে৷ এরমধ্যে ধান সংগ্রহ করা হবে দেড় লাখ মেট্রিক টন৷ বাকিটা চাল ও গম৷ এটা মোট উৎপাদনের ৫ শতাংশের বেশি নয়৷ আর চাল সরকার কৃষকের কাছ থেকে কেনে না, কেনে মিল মালিকদের কাছ থেকে৷
তবে ধানও কি কৃষকদের কাছ থেকে কেনা হয়?এই প্রশ্নের জবাবে কৃষক আব্দুল মালেক বলেন, ‘‘আমি চেষ্টা করেও কখনো বিক্রি করতে পারিনি৷ আমি বার বার যোগাযোগ করেছি৷ কৃষি অফিসে গিয়েছি, খাদ্য অফিসে গিয়েছি, তারা আমার ধান কখনোই কেনেনি৷'' আর কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘সরকার কোথায় ধান কেনে তা আমার জানা নেই৷'' টাঙ্গাইলের সাংবাদিক বিজয় কুমার সাহা বলেন, ‘‘আসলে কৃষকরা সরাসরি সরকারি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে পারেন না৷ বিক্রি করার দালাল আছে৷ তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে সরকারি গুদামে বিক্রি করে৷ আর এই মধ্যবর্তী লাভের ভাগ নেয়ার জন্য একটি চক্র আছে৷ এই চক্রের সাথে খাদ্য গুদামের কর্মকর্তারাও জড়িত৷''
আর কৃষকরা চাইলেই সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেন না৷ বাসাইল উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক কণককান্তি দেবনাথ জানান, ‘কৃষককে তালিকাভূক্ত হতে হবে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে, ধানে নির্দিষ্ট আর্দ্রতা থাকতে হবে আর তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে হবে৷ তালিকাভুক্তিরণ কাজ করে কৃষি অফিস৷''
তিনি দালালের মাধ্যমে ধান কেনার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘এবার আমার উপজেলায় ৩৪৩ মেট্রিক টন ধান কেনার অনুমতি আছে৷ তাই সবার ধান তো কিনতে পারবো না৷ তাই যাঁরা আগে আসবেন, তাঁদের ধান আগে কিনবো৷ তবে এখন পর্যন্ত কেউ আসেননি৷''
২০১৮ সালে বাংলাদেশে বোরো ধান উৎপাদনে নতুন রেকর্ডসৃষ্টি হয়েছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে গত বছর বাংলাদেশে ৪৮ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে৷ উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৯৫ লাখ টন ধান, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি৷ বোরোর এই বাম্পার ফলনের বদৌলতে গত বছর মোট ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৬২ লাখ টনে পৌঁছে গেছে৷ আর দেশে মোট ধানের চাহিদা ৩ কোটি ৩০ লাখ টন৷ সেই হিসাবে দেশের মোট চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থেকে যায় ৩০ লাখ টন৷ এবারো বাম্পার ফলনের আশা করা হচ্ছে৷
২০১৭ সালে হাওরে বন্যার কারণে সরকার চাল আমদানিতে ২৬ ভাগ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়৷ ফলে দেশে অতিরিক্ত আরো ২৮ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়৷ কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে ধানের যে বাম্পার ফলন হবে তা আগেই বোঝা গেছে৷ আর ২০১৭ সালের হাওরে বন্যার কারণে শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধায় ২৭-২৮ লাখ মেট্রিক টন চাল এসেছে বাইরে থেকে৷ কিন্তু আপদ কেটে গেলেও সরকার আর চাল আমদানির ট্যারিফ বাড়ায়নি৷ এটা আসলে অ্যাডজাস্ট করা উচিত ছিল৷ আগের খাদ্যমন্ত্রী তো খাদ্য ছাড়া আর সব বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন৷ আর এখনকার খাদ্যমন্ত্রী তো আগে নাকি চালকলের মালিক ছিলেন৷ আর এখন চালকল না থাকলেও শোনা যায় তিনি চালকলের মালিকদের দ্বারা পরিচালিত৷ ধানের একদিকে বাম্পার ফলন এবং চালকল মালিকদের হাতে ধান মজুদ থাকার কারণে চালকল মালিকরা ধান কিনছে কম৷ ফলে ধানের দাম পড়ে গেছে৷ এটা সরকারের আগেই দেখা উচিত ছিল৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা আমরা অনেক বছর আগেই বলেছিলাম যে, দেশে কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দেবে৷ এখন সেটা দেখা দিয়েছে৷ আর কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে অনেক৷ আড়াইশ টাকার কৃষি শ্রমিক এখন এক হাজার টাকা৷''
তাঁর মতে, ‘‘কৃষক যদি এখন ধান বিক্রি না করে ধরে রাখতে পারত তাহলে দাম পেতো৷ কিন্তু সেই ব্যবস্থা তো সরকার করেনি৷ আর ধানের মান ভালো রাখার জন্যও তো কৃষকদের কোনো সহায়তা দেয়া হয় না৷ কৃষিমন্ত্রী রপ্তানির চিন্তা-ভাবনার কথা বলছেন৷ কিন্তু সেটা কবে? চিন্তা করে সময় কাটালে তো কৃষক সর্বশান্ত হয়ে যাবে!''
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘দাম না পাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র কৃষকরা৷ তাঁরা চালকল মালিকসহ নানা সূত্র থেকে সুদে টাকা নিয়ে চাষ করেছেন৷ এখন তাঁদের এই ধান বিক্রি করে টাকা শোধ করতে হবে৷ তাঁদের পক্ষে এই ধান দুই-তিন মাস ধরে রাখা সম্ভব নয়৷ যদি তাঁরা পারতেন তাহলে কিন্তু দাম পেতেন৷ তাই সরকার যদি তাঁদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতো, তাহলে এই সংকট মোকবেলা করতে পারত৷ এই ঋণ চাষের আগে-পরে দুই সময়ই দিতে হবে৷ আর উৎপাদন খরচ কমাতে হবে৷ ধান কাটা, মাড়াই করা এসব কাজে যন্ত্রের ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ অনেক কমে যাবে৷ এটার ব্যবস্থাও সরকারকে করতে হবে৷ এই অবস্থা কিন্তু বছরের পর বছর চলছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকার ধান কেনে সামান্যই, বেশি কেনে চাল৷ আর এই চাল কেনে চালকল থেকে৷ কৃষকের কাছ থেকে তো কেনে না৷ তাই কৃষকের ধানের সঠিক মূল্য দিতে হলে তাঁকে ধান মজুদের সক্ষমতার ব্যবস্থা করতে হবে৷''