‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার নয়’
১৩ অক্টোবর ২০২৩ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর হতে পারে? এ নিষেধাজ্ঞা কতটা যৌক্তিক?
এ এম আকাশ: প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা যে ধরনের দেশ হিসেবে দেখি, তাতে এসব নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে তারা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে থাকে৷ তারা পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডে সামরিক শাসন থাকা সত্ত্বেও তাদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে না, বাংলাদেশকে দিচ্ছে৷ বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে গণতন্ত্র বিপদাপন্ন বা সঠিক পথে চর্চিত হচ্ছে না৷ ওখানেও তো হচেছ না৷ কিন্তু ওখানে না দিয়ে এখানে দিচ্ছে কেন? এখানে দিচ্ছে মূলত জিও পলিটিক্যাল কারণে৷ চায়না থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরানোর জন্য৷ আমি তাই মনে করি৷ এখন এটা (ভিসা নীতি) কার্যকর হবে কি হবে না সেটা দ্বিতীয় প্রশ্ন৷ এই দ্বিতীয় প্রশ্নে আমার জবাব হলো- এটা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ কারণ, ভিসা নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের খুব একটা আসবে যাবে না অর্থনৈতিকভাবে৷ অর্থনৈতিকভাবে আসবে যাবে, যদি গার্মেন্টস সেক্টরে রপ্তানি বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো স্যাংশন দেয়৷ যেমন ইরানকে দিয়েছে, আরো দেশকে দিয়েছে৷ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যদি কোনো স্পেশাল প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে৷ সেটা তো এখনো করেনি৷ তো দেখা যাক কী হয়৷
আপনি বলছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-এর কথা- এটা যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন...
ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আমি বললাম থাইল্যান্ড এবং পাকিস্তান৷ যদিও ওখানে গণতন্ত্র নেই এবং সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য আছে৷ আমাদের চেয়েও খারাপ অবস্থা৷ সেখানে কোনো ভিসা নিষেধাজ্ঞা বা অন্য কিছু হচ্ছে না, চীনের ক্ষেত্রেও হচ্ছে না, তালেবানদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে না। চীন এবং তালেবানের ক্ষেত্রে বিশাল কোনো অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ হচ্ছে না। সুতরাং সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন বিশেষভাবে হচ্ছে , সেটাই হলো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড৷
আপনি কী মনে করেন, কেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে?
আমি তো বললাম এটা হচ্ছে জিও পলিটিক্স-এর কারণে। এখানে জিও পলিটিক্সটা এই জায়গায়, যেন বাংলাদেশ চীনের দিকে না যায়৷ আর বঙ্গোপসাগর এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে যেসব জোট অ্যামেরিকা গঠন করেছে, ভারত, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া এদের সঙ্গে যেন বাংলাদেশ অন্তর্ভূক্ত হয়৷
এরপরে যদি ইকোনমিক স্যাংশন দেয়, তারাও তো এটাও দেয়- আপনি বলছিলেন, তাহলে কী পরিস্থিতি হতে পারে?
তাহলে আমাদের অসুবিধা হতে পারে৷ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সেটা দেয়নি৷ সেটা দিতে পারে, যদি ওইটা না আদায় করতে পারে৷ তার তো জিও পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট৷ ফলে এটাও দিতে পারে৷
আপনি বলেছেন জিও পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট। সেটা আরো একটু ব্যাখ্যা করবেন?
বললাম তো৷ দুইবার তো বলেছি৷ চীনের থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে আনা৷
বিশ্বের ৩৫টি দেশের ওপর তো এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে-
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা জিও-পলিটিক্যালকারণে , চীনের থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে এনে বঙ্গোপসাগরে চীনবিরোধী তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছে৷ ভারত, জাপান অস্ট্রেলিয়াসহ ইন্দো-প্যাসিফিক প্রাকৃতিক ব্রিজটা করতে চাচ্ছে৷ এমনও শোনা যায় যে, রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে বার্মার সঙ্গে যদি কোনো যুদ্ধ ঘটে, তাহলে বাংলাদেশকে যাতে এই দিকে রাখা যায়, চীনের বিরুদ্ধে রাখা যায়, এগুলো অনেক সুদূরপ্রসারী চিন্তা৷ অথবা সেন্টমার্টিনে যদি কোনো যুদ্ধ ঘাঁটি তৈরি করা যায়৷ এগুলো ভিতরে ভিতরে নানা কথা শোনা যায়৷ মূলত চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব যাতে না বাড়ে৷
তারা তো এর আগে কিউবা, উত্তর কোরিয়া, নিকারাগুয়া, সিরিয়া আরো অনেক দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে-
সবই রাজনৈতিক কারণে দেয়া হয়েছে৷
তারা কি তাদের মতো করে বিশ্বটাকে গড়তে চায়, না তাদের জাতীয় স্বার্থ আছে?
তাদের ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট হলো বিশ্বে তাদের আধিপত্য৷ এক সময় ছিল বাইপোলার বিশ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম অ্যামেরিকা৷ এখন আর বাইপোলার নেই৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর তারা ভেবেছিল ইউনিপোল হিসেবে পুরো পৃথিবীতে একাধিপত্য করবে৷ অ্যামেরিকা ফার্স্ট- এটা হলো তাদের প্রথম কথা৷ ট্রাম্পের কথা, বাইডেনেরও কথা৷ সুতরাং অ্যামেরিকার ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট এবং ন্যাশনাল ডমিনেন্স ইন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড , এর জন্যই ওরা এটা করছে৷
কিউবা নিষেধাজ্ঞার পরও তাদের মতো চলছে। কিন্তু সব দেশ কি পারে কিউবার মতো?
হ্যাঁ, দাঁড়াতে পারে৷ একেক দেশের পরিস্থিতি একেক রকম৷ অনেক ঝামেলায় পড়েছে কিউবা৷ কিন্তু তার দেশপ্রেম, তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, অঙ্গীকার- এগুলোর কারণে তারা দাঁড়াতে পেরেছে৷ বাংলাদেশের তো অত দূরদর্শিতা, অঙ্গীকার নেই৷ সুতরাং তারা একটা কম্প্রোমাইজ সল্যুশন করবে আরকি৷
তারা এই নিষেধাজ্ঞা নীতিকে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে কেন? তারা এর মধ্য দিয়ে আদৌ কি কিছু অর্জন করতে পারে?
তারা তো চেষ্টা করবে৷ সবভাবেই চেষ্টা করবে৷ তারা সাংশন দিয়ে চেষ্টা করবে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চেষ্টা করবে৷ তাদের যারা বন্ধুস্থানীয় লোক তাদের সঙ্গে নৈশভোজ করে চেষ্টা করবে৷
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় তো শুধু রাশিয়া নয়, আরো অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খাদ্য ও নিত্যপণ্যের সংকট তৈরি হয়েছে৷ এর প্রতিকার কী?
এটা তো বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক বিগ পাওয়ার৷ সুতরাং ওখানে কত কম স্যাকরিফাইস হবে, কত কান্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ একটা যুদ্ধে বড় স্যাক্রিফাইস করা হয় না? দাবার যুদ্ধে তো এটাতো হবেই৷
তারা তো আবার প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় না। এখন তো আবার খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷
ওটা তো আমি বললাম যে, ওদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আছে। মিত্রদের বিরুদ্ধে দেবে না। শত্রুদের বিরুদ্ধে দেবে, যাদেরকে ওরা জাতীয়ভাবে শত্রু মনে করছে৷
তারা তো নিষেধাজ্ঞার পরে অনেক দেশে আগ্রাসনও চালিয়েছে৷ ভিয়েতনামে চালিয়েছে, আফগানিস্তানে চালিয়েছে৷ ওইসব দেশে তো তাদের অভিজ্ঞতা খারাপ৷ তারপরেও কেন করে?
অভিজ্ঞতা খারাপ হলেও তারা দেবে, কারণ, যে-কোনো লোক তার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সবরকম পন্থা ব্যবহার করে৷ কোনো কোনো পন্থা সফল হয় কোনো কোনো পন্থা ব্যর্থ হয়৷ অতীতে যেসব পন্থা সফল হয়েছে সেগুলো তারা আবার চেষ্টা করবে৷ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে নতুন পন্থা আবিস্কার করবে৷ শেষ পন্থা হলো আনবিক যুদ্ধ৷
বাংলাদেশের কি কোনো সক্ষমতা আছে, তারা যদি আরো নিষেধাজ্ঞা দেয়, ইকোনমিক স্যাংশন দেয়-
আমি তো বললাম, বাংলাদেশের ওপর যদি ইকোনমিক স্যাংশন দেয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট হবে৷ তাছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বাংলাদেশকে কিছু করতে পারবে না, যদি না তারা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন করে তাদের পন্থি কোনো সরকারকে তারা ক্ষমতায় আনতে পারে৷
তারা তো গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে৷ বাংলাদেশে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, গণতন্ত্র সঠিক পথে এগোয়, তাহলে কি তাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য আর থাকবে?
তারা ভাবছে, গণতন্ত্র হলে তাদের পন্থি সরকার কায়েম হবে। তাদের ক্যালকুলেশন তাই৷
তারা তো গণতন্ত্র , মানবাধিকারের কথা বলে৷ আসলে তাদের দিয়ে বিশ্বের কোনো দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ভালো কোনো উদাহরণ আছে?
আমি তো আগেই বললাম গণতন্ত্র, মানবাধিকার তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়৷