সমকামিতা নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কি বদলাবে?
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮প্রশ্ন উঠেছে, এই রায় কি প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পারবে? পারলে কতটা? এক সমীক্ষা বলছে, বেশির ভাগ মানুষই সমকামিতার বিপক্ষে৷
সমকামিতা অপরাধ নয়৷ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চের রায়, সমকামী, উভকামী, রুপান্তরকামী, তথা এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষেরও নিজের পছন্দমতো যৌনসঙ্গী বেছে নেবার অধিকার আছে৷ এটা তাঁদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ সামাজিক নৈতিকতার নামে ব্যক্তি বিশেষের অধিকার খর্ব করা যায় না৷ বিচারপতিদের কথায়, আমি যা, সেভাবেই আমাকে গ্রহণ করতে হবে সমাজকে৷ কিন্তু সমাজ কী বলছে ? দিল্লিকেন্দ্রিক সেন্টার ফর দি স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটি সিএসডিএস-এর এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সমকামিতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে ৬১ শতাংশ৷ গড়ে চার জনের মধ্যে একজন মনে করেন, দুটি পুরুষ বা দুটি নারীর মধ্যে যৌনতা অন্যায় নয়৷ বয়স্কদের চেয়ে কম বয়সিরা (১৫ থেকে ১৭ বছর) সমকামিতা অন্যায় নয় বলে মনে করে৷ সমকামিতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে বিশ্বাস৷ সিএসডিএস সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় রীতিনীতিতে যাঁদের আস্থা আছে, তাঁরা সমকামিতাকে অতটা খারাপভাবে দেখেন না, যতটা দেখেন ধর্মীয় প্রথায় যাঁদের আস্থা নেই, তাঁরা৷ প্রচলিত ধারণা ছিল এর বিপরীত৷ আরো দেখা গেছে, ছোট ছোট শহর বা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বড় বড় শহরে সমকামিতার গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম৷ এটাও প্রচলিত ধারণার বিপরীত৷ পাশাপাশি, ভিন্ন মতাবলম্বীরা বলছেন, ভারতে সমকামিতাকে এমন স্বীকৃতি দেয়ার ফলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে৷ সমকামী যৌনসঙ্গীদের পারিপার্শ্বিক বাতাবরণ আরো অনুকূল হবে৷ অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, পথেঘাটে সবাই আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়েছিল, যাতে গতানুগতিক যৌনতার ধারণা পালটে যায় সমাজে৷ সম্পর্কের বাইরেও জীবন আছে৷ যৌনতা আছে৷এটা বোঝা দরকার৷ কারণ, পছন্দের ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সংবিধান৷ এই রায়ে মুক্তি পেলো প্রাইভেসি বা বলা যায় ব্যক্তি পরিসর৷ প্রচলিত সামাজিক বিধান বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি, কোনোটা দিয়েই সাংবিধানিক পথ আটকানো যায় না, বৃহত্তর সমাজকে সেটা বুঝতেই হবে৷ তারপরেও একটা ‘কিন্তু' আছে৷ সমাজের একটা অংশ মনে করেন, নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি৷ অন্যটা নয়৷
পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় মনে করেন না যে, সমকামিতা নিয়ে প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল সহসা হবে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বিধবা-বিবাহ বন্ধ করা হয়েছিল৷ ডিভোর্স হবার পরও সমাজ তাঁকে অন্য চোখে দেখে বলে স্বামী তাঁকে নেয় না৷ এই ধরনের কটুক্তি বা কথাবার্তা আইন দিয়ে আটকানো যায় না৷ যেমন ধরুন, তিন তালাক প্রথা৷ সুপ্রিম কোর্ট সেটা অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন৷ কিন্তু তারপরও চলছে আড়ালে-আবডালে৷ ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে সমাজ কর্তারা আমল দেন না৷'' তাই সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘শীর্ষ আদালতের রায়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতরবিশেষ হবে না৷ তবে হ্যাঁ, আইনের দিক থেকে হয়ত সমকামীদের শাস্তি হবে না, কারণ, আইনের চোখে তাঁরা অপরাধী নয়৷ পুলিশ হয়ত তাঁদের হয়রানি করবে না৷ তবে সমাজের আর পাঁচ জনের চোখে তাঁরা খাটো হয়েই থকবে৷ সমাজের কাছে তাঁরা বাঁধা পড়ে থাকবে৷ সমকামীদের যৌনসুখ থাকবে, এ আবার কী কথা ?''
সুপ্রিম কোর্টের রায় ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে এখন কার্যকর হচ্ছে না৷ সেরাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোঁড়ামি রয়েছে৷ সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা পুরুষতান্ত্রিক৷ তার উপর ইসলামিক জঙ্গিদের রক্তচক্ষু তা বলবৎ হতে দেবে না৷ সেই কারণে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এবং অন্যান্য নেতারা শীর্ষ আদালতের রায় নিয়ে একটি কথাও বলেননি৷ যদিও তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে সব বিষয়ে মন্তব্য করে থাকেন৷ অবশ্য, আদালতে রায় আপনা-আপনি জম্মু-কাশ্মীরে কার্যকর হয় না৷ সেজন্য পৃথক আইনি বিধি আছে৷ তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন. রাজ্যে যাতে তা কার্যকর হয়, তার জন্য আন্দোলন শুরু করবেন৷ এক হিসেব অনুযায়ী, কাশ্মীরে প্রায় ৭০ লাখ সমকামী রয়েছে৷ কিন্তু ভয়ে তাঁরা কেউ মুখ খুলতে সাহস করেনি৷