হাতি আর মানুষের সংঘাত
১৯ জানুয়ারি ২০১২হাতির দল তাদের জায়গা দখল করতে চড়াও হচ্ছে মানুষের থাকার জায়গায়৷ ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে ঘর-বাড়ি৷ নষ্ট করছে কৃষি জমি৷ শ্রীলঙ্কার একটি গ্রামের নাম ব়্যান্ডুনে ভেভা৷ অ্যাঞ্জি ম্যাগিলিন নোনার সেখানেই বাস৷ তিনি জানালেন হাতির মুখোমুখি হওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা৷ তিনি বললেন,‘‘মাঝরাতে আমরা সবাই তখন ঘুমিয়ে আছি৷ সেই সময় একটা হাতি মাটির তৈরি বাড়ির দেয়ালটা ভেঙে ফেলে৷ সামনে যা পড়েছে তা পায়ের চাপে চুরমার করে দিয়ে গেছে৷''
নোনা আরো জানান,‘‘আমি ভীষণ ক্ষেপে আছি৷ হাতিগুলো নারকেলের গাছ নষ্ট করেছে৷ ধানক্ষেত নষ্ট করেছে, চাল খেয়ে ফেলেছে, আমার বাড়ির সব জিনিসপত্র ভেঙেছে৷ সব কিছু ধ্বংস করেছে৷''
নোনাকে আশেপাশের বাড়ির মানুষ এসে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে৷ নোনা যদিও প্রাণে বেঁচে যান কিন্তু তার বাড়ির ঘরদোর একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে হাতি৷ নোনা জানান, সবমিলে প্রায় ছয় লক্ষ রুপির প্রয়োজন হবে সবকিছু ঠিকঠাক করতে৷
তবে শ্রীলঙ্কায় এ ধরণের ঘটনা এই প্রথম নয়৷ এশিয়াতে যত হাতি রয়েছে তার দশ শতাংশেরই বাস শ্রীলংকায়৷ এই হাতিগুলো আড়াই কোটি মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘাতে লিপ্ত৷ কারণ দুই পক্ষই বসবাসের জায়গার জন্য লড়ছে৷
পরিবেশবাদীরা এই সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন উপায় খুঁজছেন৷ এই সমস্যার নাম তারা দিয়েছে ‘হাতি আর মানুষের সংঘাত৷'
শ্রীলঙ্কার ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশনের প্রধান রাভি কোরেয়া এই সমস্যার ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে জানান, ‘‘আসলে হাতি নয়, মানুষই হাতির বসবাসের জায়গা দখল করে নিচ্ছে৷ আর সেখান থেকেই সমস্যা এবং সংঘাতের সূত্রপাত৷''
কোরেয়া আরো জনান, শ্রীলংকায় প্রায় পাঁচ হাজার হাতি আছে৷ প্রতি বছর অন্তত আড়াইশো হাতি মেরে ফেলা হয়৷ গত শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কা তার এক তৃতীয়াংশ হাতি হারিয়েছে৷
কৃষকরা প্রাণপনে চেষ্টা করে তাদের কৃষিজমি হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে৷ হাতির দল একবার যদি কৃষিজমির ওপর দিয়ে হেঁটে যায় তাহলে সে মরশুমে আর ফসল ফলানো সম্ভব হয় না সেই জমিতে৷ মাসের পর মাস ধরে যে খাটুনি করা হয়, তার ফল ধ্বংস করতে হাতির লাগে পাঁচ মিনিটেরও কম সময়৷
আর এর ফলেই হাতির ওপর ক্ষোভ মানুষের৷ বিশেষ করে কৃষকদের, জানান কোরেয়া৷ তাই কোন কোন জায়গায় হাতিকে মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না কৃষকরা৷ তাদের কাছে জীবন বাঁচানো, ফসল বাঁচানো, পরিবারকে রক্ষা সবার আগে৷ পরে অন্য কিছু৷
ভেসগামুভা গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, বছরের পর বছর ধরে হাতি তাদের কৃষিজমি এবং ফসল নষ্ট করছে তা তারা দেখেছেন৷ গ্রামবাসী আথুলা কুমারা জানান, ‘‘ক্রোধ আর ক্ষোভ নিয়ে মানুষ হাতির কথা বলতো, হাতির দিকে তাকাতো৷ আমাদের কাছে হাতি ছিল সবচেয়ে বড় শত্রু৷ তাই মানুষরা হাতি দেখলেই তেড়ে যেত৷ হাতিকে মেরে ফেলতো৷''
কিন্তু আজ চিত্র ভিন্ন৷ কুমারার গ্রামে হাতির জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নয়, বরং মানুষের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে৷ শ্রীলঙ্কার ওয়াইল্ড লাইফ কনসজারভেশন এই কাজটি সম্পন্ন করেছে৷ প্রতিটি গ্রামের চারপাশে বৈদ্যুতিক তার বেধে দেয়া হয়েছে৷ হাতি তারের এই পাশে আসে না৷ মানুষও অন্য পাশে যায়না৷ হাতি আর মানুষ পাশাপাশি বসবাস করছে শান্তিপূর্ণভাবে৷
কোরেয়া বলেন, ‘‘ন্যাশনাল পার্কের সীমানা বোঝার ক্ষমতা শুধুমাত্র মানুষের আছে৷ পশুপাখির তা নেই৷ এই পার্কের শুরু এখানে এবং শেষ সীমানা এই পর্যন্ত, সেটা মানুষকেই বোঝানো সম্ভব হাতিকে নয়৷ ভেসগামুভা গ্রামের মানুষরা তাদের কৃষিকাজ করছে নির্বিঘ্নে৷ তাদের ফসল উৎপাদন গত দুই বছরে দ্বিগুণ হয়েছে৷ ফসল বিক্রি করে অর্থ উপার্জিত হয়েছে তিনগুন৷''
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক