যৌনকর্মী শাহনাজের কাহিনি
২৪ জানুয়ারি ২০১৭‘‘পত্রিকা খুললেই আপনি পাবেন শিশু ধর্ষণ, ছাত্রী ধর্ষণ অথবা গৃহবধু ধর্ষণের কথা৷ এত মেয়ে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছে, তারপরও কিন্তু ধর্ষিত হচ্ছে নারী৷ আমাদের মতো এই মেয়েরা যদি সেবা না দিত, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতো? একবার ভেবে দেখেছেন?'' ডয়চে ভেলেকে এ কথাগুলো বলেছেন শাহনাজ বেগম৷ একটা সময় যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতেন শাহনাজ৷ তবে কিছুদিন আগে এই পেশার নারীদের নিয়ে নিজেই শুরু করেছেন একটা এনজিও৷
ডয়চে ভেলে: আপনি কতদিন এই পেশায় ছিলেন?
শাহনাজ বেগম: আমি ১২ বছর বয়স থেকে এই পেশায় ছিলাম৷ এখন আমার বয়স ৪৮ বছর৷
আর এখন আপনি এই পেশায় যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করছেন?
জ্বী৷ আমি একটা সংগঠন করেছি৷ সংগঠনটির নাম ‘জীবনের আলো'৷
আপনি কেন এই পেশায় এসেছিলেন? কীভাবে এসেছিলেন?
পরিস্থিতির শিকার আমি৷ মা মারা যায় ছোটকালে৷ বাবা আবার বিয়ে করে৷ বিভিন্ন কারণে এই পেশায় এসে পড়ি৷ ছোট ছোট ভাই-বোন ছিল৷ তাদের খাবার দেয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত এই পেশায় আসতে হয়েছিল৷ এর আগে বিভিন্ন গার্মেন্টসে, বাসা-বাড়িতে কাজ করেছি৷ কিন্তু যেখানেই গেছি, সেখানেই ‘সেক্সচুয়ালি এক্সপ্লয়েটেড' হয়েছি৷
মানে বাসা-বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন আপনি?
হ্যাঁ, বাসা-বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে এমন অনেকবার হয়েছে৷
বাংলাদেশের পুরুষরা কি কনডম ব্যবহার করেন? আপনার অভিজ্ঞতা কী?
বাংলাদেশের পুরুষরা কনডম ব্যবহার করতে চান না, কারণ, তারা সেক্স করতে চান রাস্তা ঘাটে, টার্মিনালে, স্টেশনে....বিভিন্ন জায়গায়৷ এসব জায়গায় সময় স্বল্পতার জন্য কনডম ব্যবহার করতে চান না তারা৷ কনডম ব্যবহার করলে অনেক সময় লাগে৷ তাতে পুরুষরা এত মজা পান না৷
এই পেশায় আসার পর আপনার কি বড় ধরনের কোনো অসুখ হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে৷ আমার ইউটেরাসে সমস্যা হয়েছিল, পরে সেটা কেটে ফেলতে হয়েছে৷
এই পেশায় যাঁরা আছেন. তাঁরা কি মোটা হওয়ার জন্য বা যৌবন ধরে রাখার জন্য কোনো ঔষুধ সেবন করেন? আপনি কি কখনও করেছেন?
আমি এমনিতেই মোটা৷ এ কারণে আমার কোনো ওষুধ খেতে হয়নি৷ তবে মোটা হওয়ার জন্য যৌনপল্লির মেয়েরা সাধারণত ‘ওরাডেক্সন' নামে একটা ওষুধ আছে, সেটা খায়৷
এগুলোর নিশ্চয়ই নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে?
তা তো আছেই৷ এটা খেলে শরীরের মাংস ঝুলে যায়, ফলে দেখতে মোটা লাগে৷ তবে শুনেছি পরে ক্যানসারের মতো অসুখও নাকি হয় এর থেকে৷
এই পেশার উপার্জন দিয়ে কি আসলে সংসার চলে?
এই রাস্তার মেয়েগুলো নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে এই পেশায় এসেছে৷ হয় স্বামীর কাছ থেকে, না হয় ভালোবাসার লোকের কাছ থেকে, অথবা গ্রামের কারো কাছ থেকে নির্যাতিত হয়েই সে এই পেশায় এসেছে৷ আসলে কেউই নিজের ইচ্ছায় এই পেশায় আসতে চায় না৷ বাংলাদেশ একটা ‘মুসলিম কান্ট্রি'৷ তাই ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা শিক্ষা পায় নামাজ পড়ো, রোজা করো, সতীত্ব ধরে রাখো৷ কারণ তারা শেখে যে সতিত্বই সবচেয়ে বড় সম্বল৷ তাই টাকার বিনিময়ে কেউই এটা বিক্রি করতে চায় না৷ কিন্তু মেয়েদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তাদের এখানে আসতে হয়৷ বেশির ভাগ মেয়েই অভাব-অনটন থেকে বা আঘাত পেয়েই এই পেশায় আসে৷ তারপর এখানে এসে ওরা যে টাকাটা আয় করে, সেটার একটা বড় ভাগ দালালরা নিয়ে যায়৷ সংসার চালাতে পারে শতকরা দু-একজন৷ এই পেশাটা তো বৈধ না, সে কারণে সবাই এদের ওপর মাতবরি করে৷ এমনকি রাস্তার টোকাইও সেক্স ওয়ার্কারদের মারধর করে তাদের টাকা কেড়ে নেয়৷
এই পেশায় যাঁরা আছেন, তাঁদের তো সমাজ ভালো চোখে দেখে না৷ এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ভালো চোখে দেখে না, এটা সত্যি৷ সমাজ তাদের স্বীকৃতিও দেয়নি৷ আমাদের যে সংবিধান, সেখানেও বলা নেই – এরা বৈধ না অবৈধ৷ যদি অবৈধ লেখা থাকত তাহলেও তারা মেনে নিত৷ সরকারি বা বেসরকারি অথবা আপনি-আমি, সকলে তাদের কী বলি? বলি ‘সেক্স ওয়ার্কার'৷ তা ‘ওয়ার্কার' মানে কী? আচ্ছা এটাও বাদ দিন৷ আমি কিন্তু সেক্স ওয়ার্কারদের সেবিকা মনে করি৷ কারণ তারা সারা জীবন সেবা দিয়ে যায়৷ পত্রিকা খুললেই আপনি পাবেন শিশু ধর্ষণ, ছাত্রী ধর্ষণ অথবা গৃহবধু ধর্ষণের কথা৷ এত মেয়ে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছে, তারপরও কিন্তু ধর্ষিত হচ্ছে নারী৷ আমাদের মতো এই মেয়েরা যদি সেবা না দিত, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতো?
এত সংগঠন, এত কাজের পরও সেক্স ওয়ার্কারদের নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো পরিবর্তন কি এসেছে?
হ্যাঁ, একটা পরিবর্তন এসেছে৷ ১৯৯৬ বা ১৯৯৭ সালে আমি সুইজারল্যান্ডে একটা সম্মেলনে গিয়েছিলাম৷ সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে কোনো সেক্স ওয়ার্কার নেই৷ সেখানে দাঁড়িয়ে আমি বলেছিলাম, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি৷ আমি সেক্স ওয়ার্কার৷' আগে সরকার তো এ কথা মনতো না, এই পেশা নিয়ে কিছুই বলত না৷ এখন অন্তত সেক্স ওয়ার্কারদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোজেক্ট ডিজাইন হচ্ছে৷ ফলে সরকারের কিছু হলেও পরিবর্তন তো হয়েছে, হচ্ছেও৷
গ্রামের মানুষ বা সাধারণ মানুষ আপনাদের পতিতা বলে৷ এটা শুনতে নিশ্চয় ভালো লাগে না?
এটা নিয়ে আমরা অনেক আন্দোলন করেছি, করছি, ভবিষ্যতেও করব৷ এটা তো আসলে আমাদের সংবিধানেই লেখা আছে৷ এটা পরিবর্তনের জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে৷
আপনার সন্তান নিশ্চয় স্কুলে যায়৷ তা সেখানে তারা কি কোনো বিড়ম্বনার শিকার হয়?
হ্যাঁ, আমার সন্তানরা স্কুলে যায়৷ আমার সন্তানদের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস করবে না৷ তবে অন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ভিন্ন৷ তাদের সন্তানরা হয়রানির শিকার হচ্ছে, শিক্ষা দিতে পারছে না, ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারছে না, ভালো চিকিৎসা দিতে পারছে না৷
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আপনাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে?
তারা আমাদের খারাপ ভাবে৷ তারা মনে করে, আমরা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করি, ধর্মবিরোধী কাজ করি৷ তারা আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, নির্যাতন করছে৷ অন্যদিকে তারাই আবার আমাদের সঙ্গে সেক্স করছে, আমাদের টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে৷ কিন্তু তখন সেটা আর কোনো পাপ না, কোনো অন্যায় না৷
সরকারের কাছে আপনার চাওয়া কী?
সরকার তো সমাজে নারী-পুরুষকে সমানাধিকার দিয়ে রেখেছে৷ কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে এটা কোনো কাজে আসবে না৷ শুধু সেক্স ওয়ার্কার নয়, নারীদের কথা বলছি৷ নারীরা সম অধিকার পেয়েও পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি, সেক্স ওয়ার্কারদের কথা তো অনেক দূরের৷ সরকারের কাছে আমার আবেদন, আমাদের যেন সম অধিকারটুকু দেয়৷
এই পেশায় তো অনেক মেয়ে জড়িত, তাঁদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
দেখুন, এই যে আপনি আজ সাংবাদিক হয়েছেন....এটা কি নিজের ইচ্ছায় হয়েছেন, না বাবা-মায়ের ইচ্ছায়? আপনি হয়ত নিজের ইচ্ছাতেই সাংবাদিক হয়েছেন৷ কিন্তু বাংলাদেশে কতভাগ মানুষ নিজের ইচ্ছামতো পেশায় আসতে পারে? সংবিধানেও নিজের ইচ্ছাতে পেশায় আসার কথা বলা হয়েছে, সেটা কি হচ্ছে? সেক্স ওয়ার্কারদের যারা এই পেশায় আছে, সরকার তো তাদের বাধা দিতে পারে না৷ আমার দাবি, সেক্স ওয়ার্কারদের ওপর নির্যাতন কমাতে হবে৷ যারা এই পেশায় সন্তুষ্ট, তারা থাকবে৷ আর যারা থাকতে চায় না, সরকার যেন তাদের পুনর্বাসন করে৷
বন্ধু, সাক্ষাৎকারটি আপনার কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷