‘ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিকই আছে’
৪ মার্চ ২০২২এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক প্রধান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ৷
ডয়চে ভেলে : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী ঠিক আছে?
মুন্সি ফয়েজ আহমেদ : আমার তো মনে হয় ঠিকই আছে৷ বাংলাদেশ হৈ চৈ করছে না৷ কিন্তু যখন কথা বলছে, তখন তো বলছে দুই পক্ষই যেন সংযত থাকে এবং যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়৷ এটাই সঠিক অবস্থান৷ আমি মনে করি, যারা এই পক্ষ বা ওই পক্ষকে সমর্থন করছে সেটা সঠিক নয়৷ যুদ্ধ একদিন বেশি চললে তাতে মানুষেরই ক্ষতি হয়৷ মানুষের জীবন যায়, সম্পদের ক্ষতি হয়৷ কীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করা যায়, সেটাই সবার চেষ্টা করা উচিত৷ বাংলাদেশ যেটা করে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, এটা যদি সবাই গ্রহণ করতে পারে তাহলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব৷ আমরা যদি কাউকে না কাউকে প্রতিদিন শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করি তাহলে তো আমরা যুদ্ধের ব্যবস্থা করেই রাখলাম৷ তাহলে তো সে যুদ্ধ অবধারিতভাবে হবে এবং বহু মানুষের জীবননাশ হবে, সম্পত্তির ক্ষতি হবে৷ ফলে বাংলাদেশ কোন পক্ষকেই উৎসাহ দিতে চায় না, তারা চায় যুদ্ধটা বন্ধ হোক৷
দেশের কূটনীতিতে এই মুহূর্তে কোনো ঘাটতি দেখছেন?
আমাদের কূটনীতি হচ্ছে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা৷ যুদ্ধ লাগবেই সেটা তো আর আমরা আগে থেকে ধরে নিতে পারি না৷ যতদিন যুদ্ধ লাগেনি, ততদিন আমরা বলার চেষ্টা করেছি, তোমরা যুদ্ধ করো না৷ কীভাবে মিটমাট করা যায়, সবাই সেই চেষ্টা করো৷ এখানে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, প্রথম থেকেই রাশিয়া চায়, ইউক্রেনে যেন ন্যাটোর সম্প্রসারণ না ঘটে৷ এবং ইউক্রেন যেন নিরপেক্ষ থাকে৷ ইউক্রেন যদি নিরপেক্ষ থাকত, তা হলে কার ক্ষতি হতো, কীসের ক্ষতি হতো? সেটা তো আমি বুঝি না৷ আমি মনে করি, তারা নিরপেক্ষ থাকলে তাদেরও লাভ, অন্যদেরও লাভ৷ সুইজারল্যান্ড পৃথিবীতে একটা সম্মানজনক দেশ কিনা? নিরপেক্ষতার কারণেই তো তারা সেই সম্মানটা পেয়েছে৷ আমার মনে হয়, কী হলে সব পক্ষের মুখ রক্ষা হয় এবং যুদ্ধটা থামানো যায় সেই চিন্তাই সবার করা উচিৎ৷ এক পক্ষকে আমরা একঘরে করে দিচ্ছি, তাতে সে মরিয়া হয়ে উঠবে, সে তখন কামড় দেবে সেটাই তো স্বাভাবিক৷ কারো পিঠ যদি দেওয়ালে ঠেকে যায়, সে তখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করবেই৷ তাহলে সে অবস্থানে কেন আমরা কাউকে নিয়ে যাব? শত্রু-শত্রু, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা বন্ধ করে যার যেটায় কমতি আছে, সেটা তাকে দিয়ে, আর যার যেটা বেশি আছে সেটা সবার সঙ্গে শেয়ার করে নিক, এভাবেই কিন্তু সভ্যতা এগিয়ে যেতে পারে৷
ইউক্রেনে বাংলাদেশিদের কী আগে ফিরিয়ে আনা যেতো না?
আগে কেন ফিরিয়ে আনতে হবে? যুদ্ধ যে লাগবেই সেটা তো অবধারিত ছিল না৷ অনেকেই চেষ্টা করেছে যুদ্ধ লাগানোর জন্য৷ কেবল যারা অস্ত্র তৈরি আর বিক্রি করে তাদেরই কেবল স্বার্থ আছে যুদ্ধে৷ আর কারও কোন স্বার্থ এখানে নেই৷
দুই পক্ষের একটা উত্তেজনা তো আগে থেকেই ছিল৷ আগে থেকে যদি আমাদের প্রস্তুতিটা থাকত, তাহলে কী আরও দ্রুত বাংলাদেশীদের নিরাপদ জায়গায় নেওয়া যেত না?
ইউক্রেনে যে বাংলাদেশিরা আছে তাদের সহযোগিতায় তো দূতাবাস, সরকার এবং পোল্যান্ড ও বেলারুশের নাগরিকেরা এগিয়ে আসছে৷ মোটামুটি একটা স্বস্তিমূলক ব্যবস্থাই তো তাদের জন্য হচ্ছে৷ কেউ কেউ আছে তাদের অন্য স্বার্থ আছে, কেউ বিয়ে করেছে, কারও ব্যবসা আছে তারা হয়ত বেরিয়ে আসতে দেরি করছে৷ সুযোগ পেলে তারাও বেরিয়ে আসবে৷ কাউকে যে বাধা দেওয়া হচ্ছে তাও তো নয়৷ বা যারা যুদ্ধ করছে তারা যে কাউকে বেরিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে তাও নয়৷ কেউ যদি যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে যায়, তার তখন ক্ষতি হতে পারে৷ আমরা যতদূর জানলাম, ভারতের একজন স্টুডেন্ট যুদ্ধের মধ্যে পড়ে মারা গেছে৷ সেই দিক থেকে বাঙালিরা একটা স্বস্তিমূলক অবস্থার মধ্যেই আছে৷ এটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করার কিছু নেই৷
কৌশলগতভাবে এই যুদ্ধকে আপনি কীভাবে ব্যাখা করবেন?
একটা দেশকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এখন তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করছে৷ সমস্ত দোষ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু তারা যে এতদিন চিৎকার করল আমাদের নিরাপত্তা দাও৷ সে ব্যবস্থা তো কেউ করেনি৷ রাশিয়া কী ইউরোপের বাইরের কোন দেশ৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন হলো তখন তো সবাই আশা করেছিল, ইউরোপ তাকে কাছে টেনে নেবে৷ আমরা যেটা বলি, অর্ন্তভুক্তিমূলক সহযোগিতা৷ সেটা তো হলো না৷ উল্টো তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া হল৷ যুদ্ধ নিশ্চিত করার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় তো ছিল না৷ এখানে মার্কিন সামরিক কমপ্লেক্সের স্বার্থ আছে, কিন্তু মার্কিন সাধারণ নাগরিকদের কোন স্বার্থ তো নেই৷ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না, যাদেরই সামরিক কমপ্লেক্স আছে, অস্ত্র বিক্রির ব্যবসা আছে তারা তো যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে চাইবেই৷
এই যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে?
এই যুদ্ধে একটা পরিণতি তো আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনি যে দেশের গণমাধ্যমে কাজ করেন সেই জার্মানি যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্রের ব্যাপারে তাদের অনেক বছরের নীতিগুলো থেকে সরে আসছে৷ এটা তো ভালো লক্ষণ না৷ এখন একটা উত্তেজনা আছে, মানুষ কিছু মনে করছে না৷ কিন্তু একটা সময় তো মানুষ চিন্তা করবে এটা কী ঠিক ছিলো? যেমন জাপান যুদ্ধের ব্যাপারে তাদের যে নীতি ছিল সেখান থেকে সরে এসেছে৷
বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে?
মূলত, আমাদের যেসব লোক সেখানে আছে তাদের উপর প্রভাব পড়ছে৷ বড় আকারে যেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রভাব৷ যেমন তেলের দাম বেড়ে গেছে, সেটা আমাদের প্রভাবিত করতে পারে৷ এছাড়া গম, সার এগুলোর দাম বেড়ে যেতে পারে৷ সাপ্লাই চেইন বাধাগ্রস্থ হতে পারে৷ রাশিয়ায় আমরা যথেষ্ট রপ্তানি করছি, সেখানে সমস্যা হতে পারে৷ রাশিয়ার সঙ্গে যেসব প্রজেক্ট আছে সেগুলো বাধাগ্রস্থ হতে পারে৷ সাধারণভাবে সারা পৃথিবীতে যদি ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা দেখা যায়, ক্ষতি হয় এবং জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে৷ সেটার নেতিবাচক প্রভাব তো আমাদের উপর পড়বেই৷
ইউক্রেন যদি রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ইউরোপে এর প্রভাব কেমন হবে?
আমি তো ওইদিকে যেতেই চাই না৷ ইউক্রেনে তো এক সময় রাশিয়ার প্রভাব ছিলই, এখন সেখান থেকে তারা বের হয়ে আসছে৷ তারা যদি নিরপেক্ষ থাকে তাহলে তো সেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব৷ সেই চেষ্টাটা কেন তারা করছে না৷ তার বন্ধুদেশগুলোও তাকে সেইখানে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করছে না কেন? আমার কাছে সেটা আশ্চর্য্য লাগে৷ যদি তাদের খারাপ অবস্থা হয়, যদিও আমার মনে হয় ততদূর গড়াবে না৷ তাহলে সেটাও শেষ অবস্থা নয়৷ কোন দেশ যদি জোর করে কারও উপর প্রভাব বিস্তার করে সেই প্রভাব বেশিদিন টেকে না৷
ইউক্রেনে ব্যর্থ হলে পুতিন বা রাশিয়া কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে?
রাশিয়ার ক্ষতি করার জন্য তো সবাই উঠে পড়ে লেগেই আছে৷ আমার মনে হয় না, কেউ এমন কিছু করবে যে, রাশিয়াকে ভেঙে চুরে ধ্বংস করে দেবে৷ সেটা করার চেষ্টা মনে হয় কেউ করবে না৷ যদি তেমনই হয়, তাহলে রাশিয়া মনের মধ্যে সেটা পুষে রাখবে এবং একটা সময় তারা ব্যবস্থা নেবে৷ তখন আবার যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যাবে৷ সব পক্ষ খুশি থাকে এমন একটা সমাধান বের করতে পারলে সেটা সবার সঙ্গে মঙ্গলজনক হবে৷