উসকানি কী, উসকানি কেন?
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮উসকানির ইংরেজি হিসেবে দু'টি প্রতিশব্দ বহুল ব্যবহৃত হয় - Provocation ও Incitement৷ আর বাংলাদেশের আইনে এই ইংরেজি দু'টি শব্দেরই প্রতিফলন দেখা যায়৷ দণ্ডবিধি প্ররোচনার সংজ্ঞায় উসকানি শব্দটি এসেছে৷ দণ্ডবিধির ১০৭ ধারায় প্ররোচনার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে অপরাধ সংঘটনের জন্য সহায়তা করে, পরামর্শ দেয় বা উসকানি দেয় কিংবা ষড়যন্ত্র করে বা কার্যবিরতির দ্বারা অপরাধ সংঘটনের পথ সুগাম করে দেয় তবে তাকে প্ররোচনা বলে৷''
এই সংজ্ঞায় স্পষ্ট যে, কোনো অপরাধে প্ররোচনা দেয়া যায় উসকানির মাধ্যমে৷ আর এর শাস্তি মূল অপরাধের সমান৷ অপরাধটি সংঘটিত না হলেও উসকানির অপরাধে সাত বছরের শাস্তির বিধান আছে৷
আর দণ্ডবিধির ৫০৫ এবং ৫০৫ (ক) ধারায় উসকানির মাধ্যম বলা আছে৷ তাতে বলা হয়েছে উসকানি হতে পারে মৌখিক এবং লিখিত উভয় প্রকার৷
অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায়ও উসকানির বিষয়টি রয়েছে৷ এই আইনে ইলেক্ট্রনিক বিন্যাস ব্যবহার করে উসকানি দেয়ার বিষয়টি অপরাধ হিসেবে গণ্য৷ আর এটি কোনো ব্যক্তি, রাষ্ট্র বা ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়ে হতে পারে৷
বাংলাদেশের সংবিধানেও উসকানির বিষয়টি রয়েছে৷ সংবিধানের প্রথম ভাগে রাষ্ট্রদোহের অভিযোগ এবং তাতে উসকানির অভিযোগ সমান অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে৷
ইতিহাস
বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় উসকানি এবং অপরাধের উসকানি বহুল পরিচিত৷ ধর্মীয় উসকানি স্বাধীন বাংলাদেশেতো বটেই, পাকিস্তান এবং ব্রিটিশ ভারতেও লক্ষ্য করা গেছে৷ আর এই উসকানি কোনো স্বার্থান্বেষী মহল ছাড়াও কখনো কখনো সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকেও দেয়ার অভিযোগ আছে৷ এমনকি কখনো কখনো সংবাদমাধ্যমও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ আছে৷ ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক এরশাদের পতন যখন ঘনিয়ে আসে তখন গণআন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়া হয়েছিল৷ এ কাজে একটি দৈনিক পত্রিকাকে ব্যবহার করা হয়৷ ৩১ অক্টোবর ঐ পত্রিকাটি ভারতের বাবরি মসজিদ ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার খবর প্রকাশ করে আট কলামে প্রথম পাতায় ব্যানার লিড হিসেবে৷ আর তার প্রতিক্রিয়ায় পুরনো ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়৷ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপক্রম হয়৷ এরশাদ কারফিউ জারির সুযোগ পান৷ ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী দাঙ্গার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য৷ ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ বছরে এই দাঙ্গায় নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, ছাগলনাইয়া ও সন্দ্বীপ এবং ত্রিপুরা জেলার হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রাম থানার অধীনে সর্বমোট প্রায় ২,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
বাংলাদেশে চট্টগ্রামের রামু বৌদ্ধমন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং বগুড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু বসতিতে হামলার পেছনে আছে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক উসকানি৷ আর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের পর হেফাজতের উসকানিতো সবার জানা৷ শাহবাগ আন্দোলনকে তারা নাস্তিকদের আন্দোলন বলে প্রচারণা চালায়, যার পরিণতি ছিল মতিঝিলের শাপলা চত্বরের তান্ডব৷
অন্যদিকে আবহমানকাল ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্যের অভিযোগ করে আসছে৷ তারা এনিয়ে হুমকি ধামকিও দেয়৷ যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের এই নিয়ে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার নজিরও অনেক৷
তবে সম্প্রতি দু'টি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য, ছবি প্রকাশ ও গুজব ছাড়ানো অভিযোগে ১৭০ জনেরও বেশি ছাত্র ও অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে মামলা ও আটকের ঘটনা ঘটেছে৷ এমনকি গৃহবধুও আটক হয়েছেন৷ কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ঢাকায় দুইজন শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ওইসব মামলা ও আটকের ঘটনা ঘটে৷ মামলাগুলোর অধিকাংশই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় করা হয়েছে৷
এরইমধ্যে খ্যাতিমান আলেকচিত্রী শহীদুল আলম ছাড়া সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন৷ তবে মামলাগুলো রয়ে গেছে৷ এছাড়াও পুলিশ উসকানি ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে অর্ধশতাধিক লিংক এবং পেজের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেছে৷ নজরদারিতে রেখেছে ফেসবুক আইডি৷
তথ্যভিত্তিক কিছু বলা উসকানি নয়
আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দণ্ডবিধির ৫০৫(ক) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি মৌখিক বা লিখিতভাবে এমন কিছু করে, প্রকাশ বা বিতরণ করে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সেবা প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য ক্ষতিকর হয় বা হতে পারে- এগুলোকে উসকানিমূলক বিষয় বলা হয়৷ আইনে বলা আছে, এই ধরণের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘একই ধরনের অপরাধ অনলাইনে করলে সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা এবং শাস্তির বিধান আছে৷ আর সংবিধানেও জনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার রক্ষায় উসকানিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে৷''
কিন্তু উসকানি বিষয়টি কী এবং এর পরিধি কী কী তা কোনো আইনেই সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই৷ তাই এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠছে বারবার৷ তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘‘এই আইনগুলোর সুবিধা নেয় সরকার ও সরকারের লোকজন৷ সাধারণ মানুষ এর কোনো সুবিধা পায়না৷ তারা তেমন আইন সম্পর্কে জানেওনা৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করা, সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা বা এইসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করা উসকানিমূলক কাজ হিসেবে বিবেচনা করা যায়না৷ কারণ এটা নাগরিকদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার৷ সরকারের কোনো অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে প্রচারণা চালানো, জনমত গড়ে তোলা এবং নাগরিকদের প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করাও উসকানি নয়৷ তবে এধরণের কাজ সঠিক তথ্যভিত্তিক হতে হবে, গুজব বা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে করা হলে তা উসকানি হবে৷''
দন্ডবিধির ৫০৫ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোনো বক্তব্য, বিবৃতি, প্রতিবেদন, গুঞ্জন যদি সত্য হয় বা সত্য হিসেবে বিশ্বাস করার কারণ থাকে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবেনা৷ তাই তথ্যভিত্তিক এবং বিশ্বাসযোগ্য কোনো কিছু বলা বা প্রকাশ উসকানি নয়৷
আইনে অস্পষ্টতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘অপরাধ বা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেয়া বা উৎসাহিত করাই হলো উসকানি৷ এটা ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় হতে পারে৷ যেমন জাপানে কোনো কোনো ধর্মগুরু একসঙ্গে অনেককে অপরাধ করতে প্ররোচনা দেন৷ দেখা যায়, ১০০ মানুষ একসঙ্গে আত্মহত্যা করেন৷ এটা অপরাধ৷ আবার রামু ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় ধর্মীয় উসকানি দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো হয়৷ গুজব ছড়িয়ে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো বা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়, এটাও উসকানি৷''
তিনি বলেন, ‘‘উসকানির সংজ্ঞায় আইনে অস্পষ্টতা আছে৷ আমাদের এখানে Incitement-কে উসকানির সাথে এক করে ফেলা হয়েছে৷ সরকারের হোক অথবা অন্যকোনো ক্ষেত্রে হোক যদি কোনো অন্যায় হয় তার প্রতিবাদ করা বা মানুষকে প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করা কোনোভাবেই উসকানি নয়৷ এটা নাগরিকদের অধিকার৷ এই ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে কেউ যদি দমন করতে চায় তা গ্রহণ করা যায়না৷ মানুষের কথা বলার অধিকার, বাকস্বাধীনতা তার সাংবিধানিক অধিকার৷ সেটাতো কেউ খর্ব করতে পারেনা৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিবাদ ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকী করেছেন৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতাতো সাংবিধানিক অধিকার৷''হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘কেউ যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো কিছু ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন পুলিশ সেখানে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে৷ তবে পুলিশকে সংবিধানের বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার, এগুলো মেনেই কাজ করতে হবে৷''