কোরবানির পশু আর চামড়ার বাজারে হতাশা
২৩ আগস্ট ২০১৮কোরবানির পশুর বাজার শুরুতে ছিল বেশ চড়া৷ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস এবং ঈদুল আজহা কাছাকাছি সময়ে পড়ায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়৷ কারণ, ১৫ আগস্ট শোক দিবসে দুস্থদের খাবার বিতরণে প্রচুর গরু জবাই করা হয়৷
কিন্তু কোরবানির এক-দুইদিন আগে পশুর বাজার পড়তে থাকে৷ যে গরু এক লাখ টাকার নীচে বিক্রিতে বাজি ছিলেন না ব্যবসায়ীরা, তার দাম কোনোভাবে ৬০ হাজার টাকার বেশি বলছিলেন না ক্রেতারা৷ ফলে অনেকে গরু বিক্রি না করে ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য হন৷ আবার কেউ কেউ খরচের কথা চিন্তা করে কম দামে বা লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন৷ এমনকি কোরবানির দিন ভোররাতে অনেক ব্যাপারীকে (পশু ব্যবসায়ী) কাঁদতে দেখা গেছে৷ বিশেষ করে যাঁরা শেষ দুই দিনে কোরবানির পশু নিয়ে বাজারে এসেছেন, তাঁরাই বিপাকে পড়েছেন বেশি৷
ফরিদপুর থেকে শনির আখড়া বাজারে একশ'র মতো গরু নিয়ে এসেছিলেন বিল্লাল হোসেন৷ তিনি তাঁর সব গরুই বিক্রি করতে পেরেছেন৷ এটা কিভাবে সম্ভব হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আগেই গরু নিয়ে বাজারে এসেছি৷ শেষ সময়ের অপেক্ষা করিনি৷ কোরবানির দু'দিন আগেই বিক্রি শেষ৷ তারপরও শেষ দিকে দাম কম পেয়েছি৷ গড় দাম হিসেবে আমি চার-পাঁচ হাজার টাকার ব্যবসা করেছি প্রতিটি গরুতে৷ আমার গরু ছিল ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে৷ কিন্তু শেষের দুই দিনে যাঁরা বেশি ব্যবসা করার জন্য গরু নিয়ে এসেছেন, তাঁরা ধরা খেয়েছেন৷ কারণ, তখন বাজারে আবার নতুন গরু এসেছে৷''
কোথা থেকে শেষ সময়ে নতুন গরু এলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘খামারিরা ওই সময়ে গরু বাজারে নিয়ে এসেছে৷ আর ভারত ও মিয়ানমার থেকেও গরু এসেছে বলে শুনেছি৷ কিন্তু আমি দেখিনি৷''
সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছিল, দেশে কোরবানির গরু-ছাগলের পর্যাপ্ত মজুদ আছে৷ রবিবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিকে জানায়, এবার ঈদুল আজহায় কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু (সব ধরনের পশু) রয়েছে প্রায় এক কোটি ১৬ লাখ৷ গত বছর এ সংখ্যা ছিল এক কোটি চার লাখ ২২ হাজার৷ বাংলাদেশে কোরবানিতে ২৫-৩০ লাখ গরু কোরবানি হয়৷ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ২০১৬ সালে দেশে পশু কোরবানি হয়েছে এক কোটি তিন লাখ (সব ধরনের পশু)৷ ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল এক কোটি পাঁচ লাখ৷ সে অনুযায়ী এবার পাঁচ বা ১০ ভাগ কোরবানি বেশি হলেও এক কোটি ১৬ লাখ পশু যথেষ্ট৷ তবে কথা বলে জানা গেছে, কোনোভাবেই ৪০ লাখের বেশি গরু কোরবানি হয় না্৷
কথা বলে জানা গেছে, শুরুর দিকে কোরবানির পশুর দাম বেশি থাকায় অনেক ব্যাপারীই পশু ধরে রাখছিলেন আরো বেশি দামের আশায়৷ শেষের দিকে বাজারে সরবরাহ বাড়ায় তাঁদের মাথায় হাত পড়ে৷ গাবতলির ব্যাপারী দুদু মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অনেকে গরু ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷ কারণ, তাঁরা কেনা দামও পাচ্ছিলেন না, কেননা, একটি গরু ৬-৭ মাস আগে কেনা হয়, বাজারে নিয়ে আসা পর্যন্ত গরুর পিছনে অনেক খরচ আছে৷ আবার কেউ কেউ লোকসান দিয়েও বিক্রি করেছেন৷ কারণ, গরু ফেরত নিয়ে গেলে আবারো খাওয়াতে হবে, পুষতে হবে৷ তাতে লোকসান আরো বেড়ে যাবে৷ কসাইরা গরু কেনে বাজারে মাংশের কেজি কত দাম তা দেখে ব্যবসার হিসাব করে৷''
সাংবাদিক শাহেদ শফিক এবার গরুর হাট নিয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গরুর বাজার ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যে রাখায় শেষ দিকে সীমান্ত বলতে গেলে খুলে দেয়া হয়৷ শেষ দুই দিনে ১৬ লাখ গরু এসেছে প্রতিবেশী দেশ থেকে৷''
চামড়ার দাম নিয়ে হতাশা
এ বছর চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দেয় সাকার, তা আগের বছরের চেয়ে কম৷ এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫ থেকে ৫০ টাকা; ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার৷ এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়৷ গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা; ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং খাসির চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল৷ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার চামড়ার দাম গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম৷ কোনো গরুর চামড়াই সাতশ' টাকার বেশি দামে নিতে চান না পাইকাররা৷ ফলে ফরিয়াদের মধ্যে যাঁরা একটু বেশি দামে কিনেছেন, তাঁরা বিপাকে পড়েছেন৷ ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম ধরা হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা৷
কলাবাগানের ব্যবসায়ী মিন্টু মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত বছর আমি ৬০ হাজার টাকায় একটি গরু কোরবানি দিয়ে চামড়া বিক্রি করি সাতশ' টাকায়৷ এবার ৯০ হাজার টাকায় গরু কোরবানি দিয়ে চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র পাঁচশ' টাকায়৷ তবে এবার চামড়া নিয়ে তেমন কোনো কাড়াকাড়ি ছিল না৷ চামড়া জোর করে নেয়ার সন্ত্রাসী তৎপরতাও চোখে পড়েনি৷''
ঢাকার পোস্তা এবং সাভার কাঁচা চামড়া বিক্রির সবচেয়ে বড় আড়ৎ৷ সেই সব আড়তে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে অপেক্ষা করেও বিক্রি করতে পারছেন না৷ কারণ, ব্যবসায়ীরা অনেক কম দাম বলছেন৷ ইব্রাহিম নামে একজন মৌসুমি ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘আমি এক হাজার পিসের মতো গরুর চামড়া কিনেছি৷ গড়ে দাম পড়েছে সাতশ' টাকার কিছু বেশি, কিন্তু আড়ৎদাররা কোনো চামড়াই সাতশ' টাকার বেশি দাম দিতে রাজি হচ্ছেন না৷ যদি এই পরিস্থিতিই চলে, তাহলে আমাকে লোকসান গুনতে হবে৷''
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিশন (বিএফএলএলএফইএ)-র জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান ও আনোয়ার ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলজাহান ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সরকারকে চামড়ার দাম এর চেয়েও কম প্রস্তাব করেছিলাম৷ কারণ, বিশ্ব বাজারে চামড়ার দাম কম৷ আমাদের গত বছরের কেনা অনেক চামড়া এখনো বিক্রি করতে পারিনি৷ বেশি দামে কিনে এখন লোকসান দিতে হচ্ছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আগে বাংলাদেশের চামড়ার বড় ক্রেতা ছিল কোরিয়া৷ এখন চীন৷ চীন চামড়া পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রে৷ যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে চামড়া আমদানির ওপর নতুন করে কর বসিয়েছে৷ সেটা কাভার করার জন্য চীন এখন আমাদের কাছ থেকে নেয়া চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে৷''
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে সারাদেশ থেকে কমবেশি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া৷ মোট চামড়ার অর্ধেকের বেশি পাওয়া যায় কোরবানির সময়৷