দুর্নীতির লজ্জায় ডুবছে বাঙালি, কোন পথে রাজনীতির শুদ্ধিকরণ?
৩০ জুলাই ২০২২শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের মতো এত বড় মাপের দুর্নীতি বাংলার মানুষ দেখেননি৷ এসএসসি দুর্নীতি মামলায় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তার৷ তার ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে দফায় দফায় উদ্ধার ৪০ কোটির বেশি নগদ টাকা, গয়না৷ খোঁজ মিলেছে অন্যান্য সম্পত্তির৷ গ্রেপ্তারের ছয়দিন পর পার্থকে মন্ত্রিত্ব ও দলের সাংগঠনিক পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু এত টাকা উদ্ধার, তার আগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ কি একজন ব্যক্তির অপসারণে মুছে ফেলা যায়? নাকি এভাবে শুদ্ধিকরণের প্রয়াস সফল হতে পারে?
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেদুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়৷ সাড়ে তিন দশকের বাম আমলে অনিয়মের অভিযোগ বারবার উঠেছে৷ তবে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরাসরি এমন অভিযোগ ও বিপুল টাকা উদ্ধার বাংলার মানুষের কাছে অভূতপূর্ব৷প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রাক্তন অধ্যক্ষ, প্রবীণ শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কিছু হবে না৷ ওই বিপুল পরিমাণ টাকা দলের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল৷ এজন্য সারা দেশের সামনে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে৷''
অথচ সারা দেশের সামনে বাংলা ছিল রোল মডেল৷ আঠারো, উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দের জীবন ও কর্মের কেন্দ্রে ছিল পরার্থপরতার ভাবনা৷ কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে দায়ী করতে রাজি নন বিদ্বজ্জনেরা৷ সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সামনে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি৷ আমাদের মূল্যবোধ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে৷আমাদের রাজনৈতিক নেতারাই এটা করেছেন৷আমাদের বেড়ে উঠতে দেয়নি, ভিক্ষুক বানিয়েছে৷হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলছে ভোট দাও৷''
যদিও বাম আমলে এমন ধারণা জনমানসে গড়ে উঠেছিল, মহাকরণ থেকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর কোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য টাকা দিতেই হবে৷সেই বাম শাসনের অবসানে বিদ্বজ্জনেরা পথে নেমেছিলেন৷ তাঁদের অন্যতম চিত্রশিল্পী সমীর আইচ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছোট-বড় সব নেতা এমনই দুর্নীতিগ্রস্ত৷ কয়েকটা প্রজন্ম এ জন্য শেষ হয়ে যাবে৷ আমরা আর সন্তানদের এটা বলতে পারব না চুরি বা অন্যায় করা মহাপাপ৷''
বামফ্রন্টের জমানায় একাধিকবার বড় শরিক সিপিএম শুদ্ধিকরণের ডাক দিয়েছে৷কিন্তু সংশোধনের চেষ্টা পার্টি দলিল ও চিঠিতে সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন৷বামেদের ক্ষেত্রে নিচুতলায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠত, শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আঙুল উঠত কম৷তৃণমূলের শাসনে শীর্ষ নেতৃত্বই অভিযুক্ত৷অভিনেতা বাদশা মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুদ্ধিকরণ তখনই সম্ভব, যখন উপরতলার নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হবে৷ তারা স্বচ্ছ না হলে নিচুতলার কর্মীরা কী করে দুর্নীতিমুক্ত হবেন৷ এই বড় সংখ্যক কর্মীরা নেতাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করবেন৷''
গত ১১ বছরের তৃণমূল শাসনে বার বার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন শীর্ষ নেতারা৷ সারদা, রোজ ভ্যালি-সহ একাধিক চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি, নারদ স্টিং অপারেশন মামলায় শাসক দলের নেতারা মূল অভিযুক্ত৷ সব অতীতকে ছাপিয়ে গিয়েছে চলতি নিয়োগ দুর্নীতি মামলা৷ প্রবীণ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শাসক দলে দুর্নীতি আছে, আমরা জানি৷ কিন্তু সেটা যে এত বড় আকারে, তা আমাদের ভাবনায় ছিল না৷ বাংলার শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতির একটা সম্মান ছিল সারা দেশে, সেটা ধুলোয় মিশে গেল৷''
আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রসঙ্গও৷ বিরোধীদের মুছে দিয়ে একাধিপত্য কায়েম করায় অভিযুক্ত ছিল সিপিএম৷ বাম আমলে মেদিনীপুরের তপন ঘোষ, শুকুর আলি থেকে উত্তর ২৪ পরগনার মজিদ মাস্টাররা বছরের পর বছর এলাকায় দাপট দেখিয়েছেন৷ এখন সেই অভিযোগ উঠছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ক্ষমতা হাতে থাকলেই তার সঙ্গে দুর্নীতির যোগ গড়ে ওঠে৷ প্রোমোটার থেকে শুরু করে নানা গোষ্ঠী ওই ক্ষমতাকে ঘিরে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করে৷ ফলে ক্ষমতা ক্রমে দুর্নীতির পাঁকে ডুবে যায়৷''
জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতার আগে বলেছিলেন, যাঁরা জনপ্রতিনিধি হবেন, তাঁদের যেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকে৷আজকের পৃথিবীতে এ কথা অলীক বলে মনে হতে পারে৷ দুর্নীতির প্রতি জনমানসের দৃষ্টিভঙ্গিও কি বদলে যায়নি? অভিযুক্ত হলেও তৃণমূলের নেতারা বিপুল জনসমর্থন পেয়েছেন৷ তাই শেষ বিচারে শুদ্ধিকরণের দায় জনতাকেই নিতে হবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা৷ পবিত্র সরকারের মন্তব্য, ‘‘মানুষকে বিচার করতে হবে আমরা কাদের সমর্থন করছি৷ তৃণমূলের মধ্যেও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ থাকতে পারেন, তাদেরও ভেবে দেখতে হবে৷ সমীর আইচের মতে, ‘‘জনতাকে পথে নামতে হবে৷ একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ নইলে আরো অন্ধকার দিন আসছে৷ তার কোনো ইঙ্গিত কি পাওয়া যাচ্ছে? স্বপ্নময় চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘উত্তরণের পথ আমার জানা নেই৷ আমি শুধু দেখছি, একটা প্রজন্ম পঙ্গু হয়ে গেল, আমরা খারাপ আছি৷ ক্রমশ আরো খারাপের দিকে যাব৷''