দেশের ‘কুকুর’ ধরাতেই উন্নতি
১২ জুন ২০২০চীন, ইটালি যখন করোনা মোকাবিলায় পুরোপুরি লকডাউনে গেছে তখন জার্মানি ‘কন্টাক্ট ব্যান’ করেছে৷ মানে, জার্মানিতে অফিস-আদালত বন্ধ করা হলেও মানুষের বাইরে বের হওয়া পুরোপুরি বন্ধ না করে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল৷ আর অর্থনীতি ভালো থাকায় বন্ধ থাকাকালীন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের সাধ্যমত নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে৷
বাংলাদেশের অর্থনীতি জার্মানি, চীন, ইটালি বা ইউরোপের মতো উন্নত নয়৷ ফলে সবকিছু বন্ধ করে নাগরিকদের কয়েকদিন বসিয়ে খাওয়ানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাছাড়া ইউরোপে শিক্ষার হার বেশি হওয়ায় তাদের করোনার দোহাই দিয়ে ঘরে বন্দি রাখা সম্ভব, যেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়৷ কারণ আমরা হচ্ছি সেই দেশের মানুষ যেখানে চাকরিতে যোগ দিতে হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে, ট্রাকে করে ঢাকায় আসে, ঈদে বাড়ি যেতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে, ট্রাকে থাকা তেলের পিপায় কোনোরকমে শরীর ঢুকিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়, পাহাড় ধসে মানুষ মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আবার পাহাড়ের কোলে চড়ে বসে৷
শুধু আমাদের কথাই বলছি কেন! আফ্রিকার মানুষরাও আমাদের মতো৷ তাইতো সরকারি সিদ্ধান্তে লকডাউন শুরুর পর কেনিয়ায় রাতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ পরেরদিন সে দেশের প্রখ্যাত সংবাদপত্রকে শিরোনাম দিয়ে মনে করিয়ে দিতে হয়, ‘আমরা কোনো যুদ্ধের মধ্যে নেই’৷ জাম্বিয়ায় লকডাউনের মধ্যে বারে জড়ো হওয়াদের উপর হামলা চালানো হয়, জিম্বাবোয়েতে নিয়ম না মেনে পণ্য বেচতে বাজারে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মারধর করা হয়৷
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, এক দেশে সফল হওয়া মডেল অন্য দেশে সফল নাও হতে পারে৷ তাই সমস্যা মোকাবিলার কাজ প্রত্যেক দেশকে নিজের মতো করাই ভালো৷
ইউরোপকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা বাংলাদেশে সংক্রমণের শুরুতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছি৷ আর যখন সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি তখন সব খুলে দিচ্ছি৷ খুলে দেয়ার কারণ আমরা ঘরে থাকতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি৷ আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে যে দিনের পর দিন চলা সম্ভব নয় সেটা এখন প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা আমজনতা সবাই বুঝতে পারছি৷
সংক্রমণ যেন না বাড়ে সেজন্যই মার্চের শেষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখনকার সংক্রমণের সংখ্যা বলছে, সেই উদ্যোগ সফল হয়নি৷
দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার কারণে আমাদের মধ্যে এখনও এমন ভাব থেকে গেছে যে, বিদেশিরা কিছু করলে, বললে মনে হয় সেটাই সেরা৷ তাইতো দেশের কোনো বিষয় নিয়ে বিদেশিরা যতদিন পর্যন্ত না প্রশংসা করেন, ততদিন সেটাকে আমাদের ভালো মনে হয় না৷ স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা হাজারবার সেটা ভালো বললেও আমরা বিশ্বাস করিনা৷
শুধু সাধারণ মানুষ কেন, সরকারের মধ্যেও এমন প্রবণতা দেখা যায়৷ তাইতো ২০১৫ সালে দুদক যখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি খুঁজে না পাওয়ার কথা জানায় তখন সরকারকে খুব বেশি খুশি হতে দেখা যায়নি৷ কিন্তু ২০১৭ সালে ক্যানাডার এক আদালত এই প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানালে সরকার সেই খবর ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু করেছিল৷
দেশের ভালোর জন্য দেশের মানুষের ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়া শুরু করতে হবে৷ বিদেশিদের পরামর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে৷ কারণ দেশি বিশেষজ্ঞরা দেশকে চেনায় সববিষয়ের একটা ‘টেইলরমেড’ সমাধান দিতে পারবেন, বিদেশিদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়৷
আর আমাদের সাধারণ নাগরিকদেরও দেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের উপর আস্থা রাখা শুরু করতে হবে৷ কারণ তাহলেই শুধু সরকারের মধ্যে দেশি পরামর্শক দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ তৈরি হবে৷ আমাদের সবাইকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর কবিতার সেই লাইনগুলো মনে রাখতে হবে৷ তিনি লিখেছিলেনঃ
কত রূপ স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া৷
দেশপ্রেম নিয়ে লেখা কবিতার এই অংশটুকুর মাধ্যমে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলতে চেয়েছেন, বিদেশের ভালো (ঠাকুর) কিছুর চেয়ে নিজ দেশের অল্প ভালো কিছু (কুকুর) নিয়েই গর্ব করা উচিত৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷