‘পশ্চিমবঙ্গে ন্যূনতম পারিশ্রমিকই প্রথম লক্ষ্য'
১০ জুলাই ২০১৮ডয়চে ভেলে: পশ্চিমবঙ্গ গৃহপরিচারিকা সমিতির এই যে ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে স্বীকৃতি, এই জোট বাঁধার শুরুটা কবে থেকে?
অক্ষয় মুখার্জি: গৃহপরিচারিকাদের একটা ফোরাম রয়েছে, একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে, সেটা হলো গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযান৷ সেখানে কলকাতা এবং দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগণার যতগুলো গৃহশ্রমিক মঞ্চ রয়েছে, তারা সবাই এই গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযানের শরিক৷ তার মধ্যে, যেমন ধরুন ‘পরিচিতি' বলে একটা সংগঠন আছে, তারা গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে৷ ‘স্প্যান' বলে একটা সংস্থা আছে, তারা কাজ করে৷ ‘দুর্বার-দিশা গৃহশ্রমিক মহিলা সমন্বয় কমিটি' আছে৷ এদিকে এই যে ‘পশ্চিমবঙ্গ গৃহ পরিচারিকা সমিতি', তারা রয়েছে৷ যারা এই ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনটা হঠাৎ পেলো৷ তারপর ‘সৃষ্টি' রয়েছে, আইএনটিইউসি রয়েছে৷ এরকম যারা, যারা গৃহশ্রমিক নিয়ে কাজ করে, তারা সমবেত হয়ে একটা মঞ্চ তৈরি করেছে৷ একটা ক্যাম্পেন তৈরি করেছে, যার নাম গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযান৷ দুর্বার দিশা এবং আরও সব সংগঠন এই প্রচার অভিযানের শরিক৷ গৃহশ্রমিকদের অধিকারের জন্য যা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়৷ এর পিছনে ‘শ্রমিক সহায়তা কেন্দ্র' বলে একটা মঞ্চ আছে, দুর্বার যার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য৷ দুর্বার, স্প্যান, পরিচিতি, সৃষ্টি, এরা সবাই৷ এরা কেবল গৃহশ্রমিক নয়, যে কোনো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে শ্রমিক সহায়তা কেন্দ্র নামে ওই যৌথ মঞ্চ তৈরি করেছিল৷ এই সহায়তা কেন্দ্রই গৃহশ্রমিকদের জন্য আলাদা এক ক্যাম্পেন তৈরি করেছিল, মূলত তাদের ন্যুনতম মজুরি ও অন্যান্য দাবিদাওয়া সরকারের কাছে তোলার জন্য৷ এখন এই মুহূর্তে যেটা চলছে, দুর্বার দিশা ও অন্যান্য সংগঠনগুলি ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের দাবি করছে সরকারের কাছে, সামাজিক সুরক্ষার দাবি করছে, এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দাবি, ন্যুনতম মজুরি৷ ১৯৪৮ সালের যে মজুরি আইন, যার প্রেক্ষিতে ভারতের রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ইত্যাদি পাঁচটা রাজ্যে ন্যুনতম মজুরি চালুও হয়ে গেছে৷ একমাত্র এই পশ্চিমবঙ্গেই হয়নি৷
আমাদের আরেকটা মঞ্চ আছে, যার নাম ‘কর্মজীবী মহিলা পরিষদ'৷ ২০১৫ সালে এই পরিষদের পক্ষ থেকে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীর কাছে আমরা ডেপুটেশন দিয়েছিলাম৷ ন্যূনতম মজুরি কীভাবে ধার্য করতে হবে, তার বিস্তারিত হিসেবসহ৷ সেই সঙ্গে অন্যান্য মঞ্চ, যেমন এই গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযান থেকে অন্যান্য দাবি পেশ করা হয়েছিল৷ তারপর, অনেক বলা-কওয়ার পর সরকার একটা কমিটি তৈরি করেছিল৷ সেই কমিটিতে সরকারপক্ষের লোক ছিল, গৃহশ্রমিকদের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি ছিল এবং ‘অ্যাকশন এইড' বলে একটি এনজিও আছে, তাদের পক্ষ থেকে একজন ছিল৷ শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক তখন বলেছিলেন, আপনাদের ব্যাপারটা চিন্তাভাবনা চলছে৷ তারপর শোনা গেল, ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ তার আগে কমিটি একটা রিপোর্ট দিয়েছে৷ তাতে বলা হয়েছে যে, হ্যাঁ, গৃহশ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পাবে৷ কিন্তু কত পাবে, কী পাবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা নেই৷ বরং বলা হয়েছে, এই ব্যাপারে আলাদা করে একটা আইন তৈরি করতে হবে৷ সেই আইনের ভিত্তিতেই গৃহশ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পাবে৷ তখন এই কর্মজীবী মহিলা পরিষদ এবং গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযানের তরফ থেকে আলাদাভাবে ডেপুটি লেবার কমিশনারকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, এই যে পাঁচটা রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি চালু হয়েছে, সেখানে কি আলাদা আইন তৈরি করার দরকার হয়েছিল? তা যখন হয়নি, তখন এখানে কেন নতুন আইন তৈরি করতে হবে?
মানে, আপনারা বলতে চেয়েছিলেন, যদি গৃহ পরিচারিকাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে শ্রম আইনেই তো ন্যুনতম মজুরি বেঁধে দেওয়া আছে৷ নতুন আইন কেন দরকার হবে?
ঠিক, ঠিক৷ একেবারেই৷ না হলে অন্য রাজ্যে দেওয়া হচ্ছে কী করে? সেখানে কি ১৯৪৮ সালের পরে অন্য আইন তৈরি হয়েছে?
এখানে আরেকটা তর্ক আছে, যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন, তাঁরা বলছেন, এখন এই গৃহপরিচারিকারা একসঙ্গে একাধিক বাড়িতে কাজ করেন এবং অনেক বেশি রোজগার করেন৷ যদি তাঁদের শ্রম আইনের আওতায় আনতে হয়, তাহলে একটি বাড়িতেই কাজ করতে হবে৷ ওখান থেকেই তাঁরা চিকিৎসার সুবিধা ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পাবেন এবং সেই সঙ্গে ন্যুনতম মজুরি পাবেন, যে অঙ্কটা অনেক কম হবে৷ এই প্রশ্নে আপনাদের কী বক্তব্য?
২০১৫ সালে আমরা যখন ন্যূনতম মজুরির হিসেব কষে দিয়েছিলাম, তখন মজুরি ধরা হয়েছিল ঘণ্টাপিছু ৪০ টাকা৷ এখন বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেই মজুরি হয়েছে ঘণ্টায় ৫৪ টাকা৷ এবার সেটাই যদি সিদ্ধান্ত হয় যে, এক ঘণ্টা কাজ করলে ৫৪ টাকা দেবে এবং কর্মদাতার সঙ্গে যদি সেরকমই চুক্তি হয়, তাহলে তাই দিক না৷ আট ঘণ্টা কাজ করলে ঘণ্টাপিছু ৫৪ টাকা করে দিক৷ এবার যে বাড়িতে কাজ করবে, তারা যদি বলে, যে না, আমরা ২-৩ ঘণ্টা কাজ করাবো, তাহলে সেই বাড়ি থেকে ২-৩ ঘণ্টার মজুরিই নেবে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার অনুযায়ী অন্য বাড়িতে কাজ করে বাকি টাকাটা তুলবে৷ সেটাও ওই ঘণ্টায় ৫৪ টাকা মজুরির হিসেবে৷ আর যদি বলে, না, একটা বাড়িতেই কাজ করতে হবে, তা হলে ন্যূনতম এত ঘণ্টা কাজ করাতে হবে৷ সেটা ঠিক হয়ে থাকবে৷ আমি যদি শ্রমিক হই, এবং আমাকে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করাতে হয়, তাহলে আমার কাজের সময়ও বেঁধে দিতে হবে৷
এবং সেখানে ঘণ্টাপিছু বাঁধা মজুরি দিলেই সমস্যাটার সমাধান হয়ে যাবে?
একেবারে, একেবারে৷ গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযান দীর্ঘদিন ধরে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে৷ এর মধ্যে, ওই পশ্চিমবঙ্গ গৃহপরিচারিকা সমিতি অনেকদিন আগে ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন চেয়ে আবেদন করেছিল৷ এবার মনে হয় তারা একটু ধরাকরা করে সেটা পেয়ে গেল৷ কিন্তু গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযান রানি রাসমনি রোড এবং শেয়ালদায় সম্প্রতি যে সমাবেশ করেছিল, সেখানে দুর্বার-দিশার সভানেত্রী বেবি নস্কর গৃহশ্রমিকদের এখনকার দাবিদাওয়া নিয়ে বক্তব্য পেশ করেছিলেন৷ তাঁরা কী ভাবছে, ভবিষ্যতে তাঁরা কীভাবে এগোবে, জানিয়েছিল৷ এর পাশাপাশি একটা দল রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী এবং লেবার কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিল৷ ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, ইত্যাদি দাবিদাওয়া নিয়ে৷ শ্রমমন্ত্রী এবং লেবার কমিশনার, দুজনেই বলেছেন, ২০১৯ সালের মধ্যে সবার রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাবে৷
আপনারা কী ভাবছেন ওই সমন্বয় মঞ্চের রেজিস্ট্রেশন করাবেন, নাকি যে শরিক সংগঠনগুলো আছে, তাদের আলাদা আলাদা রেজিস্ট্রেশন হবে?
না না, আলাদাভাবে৷ কারণ, বিভিন্ন মঞ্চ থেকে গৃহশ্রমিকদের অধিকারের জন্য লড়াই হচ্ছে৷ কাজেই সবার আলাদা রেজিস্ট্রেশন হবে৷ কিন্তু সবার একটাই লক্ষ্য৷ গৃহশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি৷
অক্ষয় মুখার্জির সঙ্গে আপনি একমত? মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷