1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গ: আমূল পরিবর্তন নাকি সাম্প্রদায়িক অতীতে ফেরা?

২৪ মার্চ ২০২১

আগামী ২৭ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে আট পর্বের বিধানসভা নির্বাচন শুরু হচ্ছে। ভারত থেকে অনেক দূরে জার্মানিতে বসে আমার মন চলে যাচ্ছে অতীতে৷ মনে পড়ছে সেই রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের কথা৷

https://p.dw.com/p/3r1y0
তৃণমূল এবার প্রচারে জোর দিয়েছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সাফল্যের উপরছবি: Payel Samanta/DW

এমন এক পরিবার আমার জন্ম, যেখানে সামাজিক মূল্যকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হতো৷ তাই আমি এই ভোটের ফল নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত৷ সত্তর ও আশির দশকের কলকাতায় আমি বেড়ে উঠেছি৷ আমার জেঠু রণজিৎ গুহর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ জেঠু আমাদের সবসময় রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল, বেসরকারিকরণ, বেকারত্ব নিয়ে খোলামেলা, যুক্তিসঙ্গত বিতর্ক করতে বলতেন৷ আমার বাবার দিকের পারিবারিক ঝোঁক ছিল বামপন্থার দিকে৷

অন্যদিকে, মায়ের বাড়ি বা মামা বাড়ি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক৷ তাদের এই ঝোঁকের অন্যতম কারণ ছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ক্যারিশমা এবং ১৯৭১ সালে বংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তাঁর যোগ৷

আমি কোন পক্ষে থাকব, সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কিছুটা মুশকিলে পড়েছিলাম৷ তখন বহুত্ববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত, যেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ ছিল৷ সেই ভারত উন্নয়নের পথে যাবে যদি অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রগতি হয় এবং লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হয়৷ কিন্তু তখন আমার দূরতম কল্পনাতেও আসেনি যে, তিন দশকের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে চলে আসবে ধর্ম৷

আমি এখন জার্মানির নাগরিক৷ তাই পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে কে জিতল, কে হারল, তাতে আমার পারতপক্ষে কিছু যায় আসে না৷ সবদিক থেকে বিচার করলে কিছু জনপ্রিয় প্রকল্প চালু করে তৃণমূল কংগ্রেস গড়পরতা শাসন করেছে৷ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা বা দুর্নীতি নিয়ে তাদের ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ মোটেই আহামরি নয়৷ বামেদের প্রভাব কার্যত শেষ হয়ে যাওয়া এবং কংগ্রেসের ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়াটা এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাস্তব৷ আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি-র উত্থান খুবই স্বাভাবিক ঘটনা৷

বিজেপি যে পশ্চিমবঙ্গ জেতার জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছে, তা আর কারো অজানা নেই৷ এ কথাও সকলে জানেন, সারা ভারত জুড়ে বিজেপি তার প্রভাব বিস্তার করতে চায়৷ উত্তর ভারতে কিছু রাজ্যে বিজেপি হেরেছে বা ভবিষ্যতে হারতে পারে৷ তার ক্ষতিপূরণ হতে পারে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে জয় পেলে৷ এই মুহূর্তে কেরালা বা তামিলনাড়ুতে বিজেপি জেতার মতো অবস্থায় নেই. সেখানে তাদের আরো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে৷ সেজন্যই নরেন্দ্র মোদীর দল পূর্ব ভারতে জয় পেতে মরিয়া৷ গত বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র তিনটি আসনে জিতেছিল বিজেপি৷ সেখান থেকে এবার তারা সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখছে৷

এখনো পর্যন্ত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয়৷ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় বিজেপি বেশিরভাগ সময়েই রাজ্যে বিধানসভা ভোটে খারাপ ফল করে৷ তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো জনপ্রিয় নেতা তাদের নেই৷ এমনকি বলিউডের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তীও জনপ্রিয়তায় মমতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন না বলেই আমার মনে হয়৷ 

তাছাড়া এবার মমতার ইস্তেহারও অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট৷ তিনি সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায়, যুব, খাদ্য, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, আবাসন, পরিকাঠামো ও নিরাপত্তার উপর৷ এটাকে বলা হচ্ছে, দিদির দশ অঙ্গিকার বা দশ দফা কর্মসূচি৷ এখন কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো তাদের যাবতীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে টিএমসি ক্যাডারদের উপর চাপ দিতে চাইবে৷ আমার আশঙ্কা, ভোটের দিন রিগিং হতে পারে, পক্ষপাতের উদাহরণও আমরা দেখতে পাবো৷

HA Asien | Debarati Guha
দেবারতি গুহ, প্রধান, ডয়চে ভেলে এশিয়া বিভাগছবি: DW/P. Böll

অন্যদিকে, বিজেপি ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য টাকা ঢালতে শুরু করেছে৷ রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের জন্য তারা সবরকম চেষ্টা করছে৷ পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ্য যেখানে ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটর আছেন৷ মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরে তাদের সংখ্যা বেশি৷

আসলে বাংলার একটা রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক ইতিহাস আছে৷ দেশভাগের পর ভয়াবহ সংঘর্ষ দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ৷ তাই যখন দেখি, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা হচ্ছে, ঘৃণা তৈরির প্রয়াস হচ্ছে, তখন আমার ভয় হয়৷ আবার অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না তো!

দুর্ভাগ্যক্রমে মতাদর্শ এখন রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে না৷ রাজনৈতিক দলগুলি এখন কেবল ক্ষমতা দখল করতে চায়৷ তার জন্য তারা অস্বাভাবিক জোট করে, এমনকি দীর্ঘদিনের শত্রুতা ভুলে বাম ও কংগ্রেস হাত মিলিয়ে নেয়৷ এই দুই দল আবার গত মাসে হুগলি জেলার ফুরফুরা শরিফের প্রভাবশালী পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি, যিনি ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট তৈরি করেছেন, তার সঙ্গেও হাত মেলায়৷

২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বাম ও কংগ্রেস মিলে ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷ সিদ্দিকির সমর্থনে তারা কিছু ভোট ফেরত পাওয়ার আশা করছে, যা তারা সাম্প্রতিক সময়ে হারিয়েছে৷ এর ফলে মনে হতে পারে, রাজ্যের কিছু আসনে ত্রিমুখি লড়াই হবে৷ তৃণমূল, বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস জোটের৷ এখন এটাও দেখার যে, শেষ পর্যন্ত আসাদুদ্দিন ওয়েইসির এআইএমআইএম কতগুলি আসনে লড়ে৷ মুসলিম ভোটের উপর তাদের প্রভাব কতটা পড়ে৷ তৃণমূলের সাফল্যের পিছনে এই বিষয়গুলি খুবই জরুরি ভূমিকা পালন করবে৷

তৃণমূল কংগ্রেসও অবশ্য রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়েছে৷ তারা 'ইমাম ভাতা', 'পুরোহিত ভাতা' চালু করেছে৷ এসব ভোট পাওয়ার কৌশল৷ এই ধরনের কৌশলের পিছনে প্রশান্ত কিশোর আছেন, যাকে নির্বাচনি কৌশল তৈরির জন্য নিয়োগ করেছে তৃণমূল৷ তিনি আগে অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কাজ করেছেন৷ এমনকি ২০১২ সালে নরেন্দ্র মোদীকে তৃতীয়বারের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী করার পিছনেও তার কৌশল কাজ করেছিল৷ ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনেও তিনি বিজেপি-র হয়ে কাজ করেছেন এবং তার কৌশল দলকে জেতাতে সাহায্য করেছে৷

আট পর্বে নির্বাচন হচ্ছে, তাই রাজ্য জুড়ে প্রচার করার জন্য বিজেপি যথেষ্ট সময় পাবে৷ অন্য রাজ্যে নির্বাচন হয় তিনটি পর্বে৷ পশ্চিমবঙ্গে আট পর্বে হচ্ছে বলে অসংখ্য জনসভা করতে পারবে বিজেপি৷ অন্যদিকে এত দীর্ঘদিন ধরে ভোটপর্ব চলায় তৃণমূল বিপাকে পড়বে৷ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে একইসঙ্গে নির্বাচন হচ্ছে বলে তারা অসুবিধায় পড়তে পারে৷

এটা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে, অনেক জেলাতে একাধিক পর্বে ভোটগ্রহণ করাটা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে৷ কারণ, তাদের বিভিন্ন জেলার সীমানা ‘সিল’ করতে হবে, যার ফলে অসুবিধায় পড়তে পারে গোটা পশ্চিমবঙ্গ৷