প্রথমবারের ভোটাররাই ভবিষ্যৎ
১৮ মার্চ ২০১৯১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে, মোট সাত দফায় ভোট হবে ভারতের ৫৪৩টি লোকসভা আসনে৷ ভোট দেবেন ৮৪ কোটি ৩০ লক্ষ ভোটার, যাঁদের মধ্যে দেড় কোটি এবারই প্রথম ভোট দেবেন৷ এঁদের প্রত্যেকেরই বয়স ১৮-১৯ বছর৷ দেড় কোটি সংখ্যাটা নেহাত কম নয়৷ জনমত সমীক্ষায় যে কারণে বারবার উঠে আসছে এই নবীন ভোটারের আশা-আকাঙ্খার কথা৷ এই প্রথমবারের ভোটারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে৷ ২০ দশশিক ১ লক্ষ৷ তার পরেই আছে উত্তরপ্রদেশ, ১৬ দশমিক ৭ লক্ষ এবং মধ্যপ্রদেশ, ১৩ দশশিক ৬ লক্ষ৷ বিদায়ী সরকারের কাজে কতটা সন্তুষ্ট এরা, নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশাই বা কী, কারা স্থিতাবস্থার পক্ষে, কারা পরিবর্তন চাইছেন — এ সবই ভোটের আগে বারবার উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে৷ সারা ভারতের নবীন ভোটারদের প্রতিক্রিয়া দেখলে একটা বিষয় সবার ক্ষেত্রেই স্পষ্ট৷ এঁরা সবাই ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা ভাবছেন৷ উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা নিয়েও এঁদের প্রত্যাশা আছে৷ তার পাশাপাশি সমাজে মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে এঁরা উদ্বিগ্ন৷ দেশে যে ধর্মীয় উত্তেজনা, সাম্প্রদায়িক অবস্থা, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই৷
কিন্তু নবীন ভোটাররা যে প্রত্যেকেই সমাজ, সময়, চলতি রাজনীতি নিয়ে খুব সচেতন, এমনটাও বলা যাচ্ছে না৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের এমন তিনজনের সঙ্গে, যারা এঁবারই প্রথম ভোট দেবেন৷ এদের একজন সৃঞ্জিতা, কলকাতার বাসিন্দা৷ কলেজে পড়েন৷ সৃঞ্জিতা পরিষ্কারই জানাচ্ছেন, কেন্দ্রে বিজেপি বা রাজ্যে তৃণমূল, প্রধান প্রতিপক্ষ দুই রাজনৈতিক দলের কারো ভূমিকাতেই তিনি খুশি নন৷ কাজেই তিনি হয়ত ‘নান অফ দ্য অ্যাবাভ', অর্থাৎ ‘নোটা'য় ভোট দেবেন৷ কোনো প্রার্থীর পক্ষেই যাবে না তাঁর রায়৷
যদিও সৃঞ্জিতা নিজে যেহেতু সরাসরি সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত নন, মূল ইস্যুগুলো হয়ত কিছুটা তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে৷ যেমন, তিনি বললেন, ‘‘আমি যেহেতু পশুপ্রেমী, যেমন (গরুকে) গোমাতা হিসেবে দেখেছে, এবং ওদের আলাদা করে (দেখভাল করার) ব্যবস্থা করেছে, আমি খুব খুশি এটাতে৷ অন্য জীবজন্তুর জন্যও এই জিনিসটা করা উচিত৷ কুকুর, বেড়াল, এদেরও যত্ন নেওয়া উচিত৷'' সৃঞ্জিতার কথাতেই স্পষ্ট যে, গোমাতা সংরক্ষণের পেছনে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সেটা তাঁর সরল চোখে ধরা পড়েনি৷ তিনি এটাকে সামগ্রিকভাবে পশু-পাখির যত্ন হিসেবেই দেখছেন৷ এ কারণে তাঁর মনে হয়, এমন যদি কোনো দল থাকত, যারা পরিবেশ বা জীবজন্তুর সুরক্ষা, সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে, তা হলে তিনি তাদেরই ভোট দিতেন৷
অন্যদিকে রাজনীতির আলোচনা থেকে আপাতভাবে অনেকটাই দূরে থাকতে চান এক মফস্বল শহরের বাসিন্দা অনন্য৷ তিনি মনে করেন, তিনি মোটামুটিভাবে রাজনীতি-সচেতন, অর্থাৎ খবর রাখেন, খবরের কাগজ, টিভিতে নজর থাকে৷ কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি দূরে থাকেন৷ এমনকি এক মাস পরে নিজের ভোটটা কাকে বা কোন দলকে দেবেন, সেটা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেননি৷ অনন্য একটা কথা খুব সোজাসুজি বলেছেন যে, এসব ব্যাপারে মাথা ঘামানোর ‘সময় হয় না'৷ ‘‘সেইভাবে আমি চিন্তা ভাবনা করি না এমনিতে৷ কাজেই ঠিক বলতেও পারছি না৷'' ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন অনন্য৷ এবং তিনি কিন্তু ব্যতিক্রম নন, বরং নিয়ম৷ সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া বা সম্প্রতি কলেজে ভর্তি হওয়া, বৃত্তিমূলক পড়াশোনার প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকা বহু ছাত্র-ছাত্রী ভোট বা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না আজকাল৷ অনন্য তা-ও হয়ত ভোটটা দিতে যাবেন, এবং তিনি সাফ জানিয়েছেন যে, প্রার্থী নয়, তিনি দল দেখেই ভোট দেন৷কিন্তু এমন অনেকেই আছে, যাঁরা ভোট দেওয়ার বয়সে পৌঁছলেও এবার ভোট দেবেন না, এমনকি ভোটার পরিচয়পত্র পর্যন্ত বানানোর চেষ্টা করেননি৷ এঁদের সবার বক্তব্য অনন্যর মতোই– ‘সময় নেই'!
তবে পড়াশোনা বা ভবিষ্যতের ভাবনায় মগ্ন থাকলেও অনেকেই আবার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে খুব স্বচ্ছ এবং তা প্রকাশ করতেও স্বচ্ছন্দ৷ যেমন মধুমতী৷ কলেজে পড়েন৷ এবার প্রথম ভোট দেবেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, ‘‘এখন ভোট ব্যাপারটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেগেটিভ ভোটিং৷ আমি রাহুলকে ভোট দিচ্ছি মানে এই নয় যে রাহুলকেই ভোট দিচ্ছি৷ হয়ত মোদীকে চাইছি না বলেই রাহুলকে ভোট দিচ্ছি৷ রাজ্য হোক, কেন্দ্র হোক, এই নেগেটিভ ভোটিং ব্যাপারটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়৷'' একই কথা কিন্তু বলেছিল সৃঞ্জিতা৷ কিন্তু কোনো প্রার্থীকেই পছন্দ নয়, ভোটের সময় সেটা জানান দেওয়ার থেকেও বেশি পরিণতমনস্ক চিন্তা নিঃসন্দেহে এই প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করতে পারা যে, কেউই ভালো নয়, কিন্তু দুজনের মধ্যে যিনি একটু কম খারাপ, তিনি ভোটটা পাবেন৷ এভাবেই নিজের রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করবে আগামী প্রজন্ম৷