প্রধানমন্ত্রী, এবার একটু ‘অহংকার’ করতে পারেন
১৫ অক্টোবর ২০১৪গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ জাতিসংঘে তাঁর ভাষণ বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ বিশেষ করে বাংলাদেশে নারী অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর প্রতিনিধিত্বের উল্লেখ করেন, তখন গণ্যমান্য শ্রোতারা করতালির মাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন৷ এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এম.এ মোমেন ডয়চে ভেলেকে এ কথা জানান৷
বাংলাদেশের নারীরা যে এগোচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের কৃতিত্বই সবচেয়ে বেশি কিনা – এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে৷ তাছাড়া যে দেশে এখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীর অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করার কথা বলা হলে সরকার এবং বিরোধীদল এক হয়ে, সমস্বরে এর প্রতিবাদ জানাতে পারে না, সে দেশে নারীর অগ্রগতির দাবির অসারতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা নিশ্চয়ই অসমীচীন নয়৷ যদি গণতান্ত্রিক দেশে নারীর প্রাপ্য স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক স্বীকৃতিসহ আরো কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়, তাহলে ‘অহংকার' করার মতো অগ্রগতি বাংলাদেশের নারীদের যে হয়নি, তা মানতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়৷
দুটি হাতের একটা দুর্বল হলে যেমন মানুষকে শারীরিকভাবে পুরোপুরি সবল, সক্ষম বলা যায়না, পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির একটা মাত্রা পর্যন্ত উত্তোরণ না ঘটলে সে সমাজের নারী বা পুরুষ খুব বেশি এগিয়েছে এমন দাবি করাও হাস্যকর৷ হাওয়ায় ফোলানো রঙিন বেলুনকে যতই সোনা দিয়ে মুড়ে দিন না কেন, বেলুন তাতে নিরেট হয় না৷ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী হলেও সমাজের বাকি সব বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করা যায় না৷
নারীর অগ্রগতির দাবিকে আরো করুণ এবং হাস্যকর মনে হয় স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও দেশের ‘বীর মাতা' স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বীরাঙ্গনাদের অসহায়ত্বের কারণে৷ বীরাঙ্গনাদের অন্য কোনো নামে ডাকা উচিত কিনা – এ বিতর্কে নাই বা গেলাম৷ দৃষ্টি শক্তি না থাকলে অশ্বত্থ গাছও অশ্বডিম্বসম৷ শ্রদ্ধা এবং সম্মানজনক স্বীকৃতি না থাকলে নামে কি বা আসে যায়!
মুক্তিযুদ্ধে সব হারালেও অনেক বীরাঙ্গনা সামাজিক স্বীকৃতি তো দূরের কথা, রাষ্ট্রের নজরেও এতদিন সম্মানের আসন পাননি৷ অনেকের জীবনেই অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী৷ এ নিয়ে ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগ ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এখনো থাকছে ভিক্ষাবৃত্তি করে বীরাঙ্গনার জীবিকা নির্বাহের খবর৷
কোনো কোনো খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও সময়-সুযোগ বুঝে একাত্তরের চেতনাকে ‘আপডেট' করে নিলেও কোনো বীরাঙ্গনা কিন্তু কখনোই তা করেননি৷ অথচ বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস না এলে তাঁদের খোঁজ কে রাখে, কে শোনে তাঁদের কথা!
বিজয় দিবসের এখনো দু'মাস বাকি৷ এমন সময়ে আগে কখনো শিরোনামে মুক্তিযোদ্ধা, নারী মুক্তিযোদ্ধা বা বীরাঙ্গনাদের স্থান পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে বলে মনে পড়ে না৷ বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের ৪৩ বছর পর বীরাঙ্গনাদের এমন ‘সৌভাগ্য' হলো৷ বর্তমান সরকার বীরাঙ্গনাদের অবশেষে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে চলেছে – এ খবর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রতিটি মানুষের জন্যই আনন্দের৷
১৯৭১ সালে যাঁদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন না – এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলেও অসন্তোষ থাকতে পারে৷ তবে '৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের হাতে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ার খবরে বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষই গর্ব বোধ করছেন৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে গর্ব করতে পারেন৷ কোনো একজনের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী কিংবা স্পিকার হওয়া তো সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণি বা পেশার দু-একজন প্রতিনিধির অগ্রগতির চিত্র৷ বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু৷