বাংলাদেশের হিমঘরে বিদেশির লাশ, স্বদেশ দূর বহুদূর
৭ অক্টোবর ২০২২চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের ফ্রিজে আছে চার বিদেশির লাশ৷ তাদের সবাই মিয়ানমারের নাগরিক৷ একজন বৌদ্ধধর্মালম্বী, বাকি তিন জন মুসলমান৷
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের ফ্রিজে আছে দুই বিদেশির লাশ৷ একজন দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে থিইসিয়া সিকেওয়েস্ট৷ অন্য মৃতদেহটি পাকিস্তানের নাগরিক মোহাম্মদ আলীর৷
মৃতদেহগুলো এতকাল মর্গে পড়ে থাকার বিষয়ে জানতে আইনজীবী, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, আইনের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক, কারা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেও তেমন কোনো সদুত্তর মেলেনি৷
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের হিমঘরে ওরা চার জন
২০১২ সালের ১৭ জুন মো. তৈয়ব নামের মিয়ানমারের এক নাগরিকের লাশ চট্টগ্রামের পাঁশলাইশ থানার কনস্টেবল রফিকুল আলম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে পৌঁছে দেন৷ পাঁচলাইশ থানার একটি জিডির (৯৭০, ১৭/০৬/২০১২) ভিত্তিতে লাশের ময়নাতদন্তও হয়৷ কিন্তু ২০ বছরেই মৃত্যুবরণ করা মিয়ানমারের সেই নাগরিকের লাশ আজও কেউ নিতে আসেননি৷ তখন থেকে হিমঘরের ফ্রিজে পড়ে আছে তৈয়বের লাশ৷
২০১২ সালের ১২ জুন কালা হোসেন নামে ৫০ বছর বয়সি মিয়ানমারের এক নাগরিকের লাশ মর্গে নিয়ে এসেছিলেন পাঁচলাইশ থানার কনস্টেবল বিদ্যালাল চাকমা৷ সেই লাশও একটা জিডির (৬৫৫, ১২/০৬/২০১২) ভিত্তিতে আনা হয়৷ কালা হোসেনের লাশের ময়না তদন্তও সম্পন্ন হয়৷ কিন্তু কালা হোসেনেরও হিমঘর থেকে দেশে ফেরা হয়নি৷
এরপর ২০১৪ সালের ২৩ জুন সহিমঁ থো নামের মিয়ানমারের আরেক নাগরিকের লাশ জিডি ১২৩৯, ২৩/০৫/২০১৪) মর্গে আনেন পাঁচলাইশ থানার কনস্টেবল শুভাশীষ বড়ুয়া৷
হাফেজ সিরাজও মিয়ানমারের নাগরিক৷ ২০১৭ সালের ১৫ মে তার লাশ মর্গে আনেন (জিডি ১০৫০, ১৪/০৫/২০১৭) আনেন কনস্টেবল হাবিব উল্লাহ৷ আগের তিনজনের মতো তার লাশও এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গের হিমঘরে পড়ে আছে৷
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে ডোমের দায়িত্ব পালন করেন মো. কদম আলী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে ডোমের কাজ করছি৷ এর মধ্যে অনেক লাশ এসেছে, চলে গেছে৷ কিন্তু এই চারটি লাশ কেউ নেয় না৷ কেউ খোঁজও নেয় না৷ স্যারদের কাছ থেকে যতদূর শুনেছি, মিয়ানমার দূতাবাসে জানানো হয়েছে, তারা কোনো উত্তর দেয় না৷ পাঁচলাইশ থানা থেকেও কোনো খোঁজ-খবর নেয় না৷”
লাশগুলোর ব্যাপারে থানা বা আদালতকে কিছু অবহিত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারি অধ্যাপক ডা. সুমন মুৎসুদ্দী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না৷ কিছু বলার ব্যাপারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে৷ ফলে আমি কিছু বলতে পারবো না৷”
মিয়ানমারের এই নাগরিকরা কোনো মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি এই লাশগুলোর বিষয়ে কিছুই জানি না৷ আমার কাছে কোনো তথ্যও নেই৷”
লাশগুলোর বিষয়ে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে জানতে পেরে পুলিশ প্রশাসনও খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে৷ পাঁচলাইশ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজিম উদ্দিন মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি ৬ মাস হলো এই থানায় এসেছি৷ ফলে এ ব্যাপারে কিছুই জানি না৷ তবে আজকেই (বৃহস্পতিবার) সহকারি কমিশনার বেলায়েত স্যার (বেলায়েত হোসেন) আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন৷ আমি আগামীকাল একজন অফিসার পাঠিয়ে এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবো৷ আমাকে কেউ আসলে বিষয়টি অবহিত করেনি৷ মেডিকেল থেকে কোনো চিঠিও আমি পাইনি৷”
ঢাকা মেডিকেলের হিমঘরে দুজনের অনিঃশেষ অপেক্ষা
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা সাউথ আফ্রিকা প্রবাসী এক ব্যক্তি বিয়ে করেছিলেন সেই দেশের নাগরিক থিইসিয়া সিকেওয়েস্টকে৷ মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান নামের ওই ব্যক্তি স্ত্রীকে নিয়ে ২০১৫ সালের শেষদিকে বাংলাদেশে আসেন৷ কিন্তু কয়েক মাস পর ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় থিইসিয়ার৷ থিইসিয়ার স্বামীকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয় তখন৷ কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হয়েছিল৷ ময়নাতদন্তে থিইসিয়ার শরীরে কীটনাশকের উপস্থিতি পেয়েছিলেন চিকিৎসকেরা৷
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শারমিন সুলতানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এখানে ফ্রিজিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় থিইসিয়ার লাশ আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে সংরক্ষনের জন্য পাঠিয়েছিলাম৷”
চৌদ্দগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শুভ রঞ্জন চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই মামলায় পুলিশ মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল৷ কিন্তু গত জুলাই মাসে হাসানুজ্জামান মারা যান৷ এখন বিষয়টি আদালতের এক্তিয়ারাধীন৷ আমাদের পক্ষে এখন আর কিছু করা সম্ভব না৷ কিভাবে লাশের সুরাহা হবে তা-ও আমরা জানি না৷”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের ইনচার্জ মোহাম্মদ সেকান্দার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৬ সাল থেকে মরদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের হিমাগারে পড়ে আছে৷ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ওই সময় মর্গের ব্যবস্থা ছিল না, সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক এই নারীর মরদেহ এখানে পাঠানো হয়৷ তখন থেকেই থিইসিয়ার লাশ নিতে কেউ আসেনি, তার বাংলাদেশি স্বামী কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা স্বজন-কেউই আসেনি লাশ নিতে৷”
বাংলাদেশে সাউথ আফ্রিকার কোনো দূতাবাস নেই৷ থিইসিয়ার নিজের দেশ থেকেও কেউ আসেনি তার খোঁজে৷
গত বছরের ১৯ জুন কারাবন্দি পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আলী (৪৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান৷ ওইদিনই লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়৷ সেই থেকে লাশটি মর্গের হিমঘরের ফ্রিজে৷ মর্গের ইনচার্জ মোহাম্মদ সেকান্দার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোন মামলায় তিনি বন্দি ছিলেন সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই৷” এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি৷
চার বছর পর দাফন হলো মার্কিন নাগরিকের লাশ
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কারের মৃতদেহ চার বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে থাকার পর গত ২৪ জুন গাজীপুরের একটি চার্চে সমাহিত করা হয়৷ উন্নয়নকর্মী বার্কারের সাথে বাংলাদেশি মাজেদা খাতুনের বিয়ে হয় ২০১৪ সালের পহেলা এপ্রিল৷ ২০১৮ সালের ২৫ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার দক্ষিণখানের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান৷ ময়নাতদন্তের পর তাকে কোথায় সমাহিত করা হবে তা নিয়ে জটিলতা শুরু হয়৷ বিদেশি নাগরিক হওয়ায় দূতাবাসের ছাড়পত্র ছাড়া তার লাশ এ দেশে সৎকার করা যাচ্ছিল না৷
গত বছর বার্কারের বাংলাদেশি স্ত্রী মাজেদা খাতুন বলেছিলেন, বার্কারের অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারকে জানানো হলেও কেউ যোগাযোগ করেনি৷ ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী এই ব্যক্তির নাম রবার্ট মাইরন বার্কার৷ প্রায় চার বছর অমীমাংসিত থাকার পর গত জুনে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং পুলিশের মাধ্যমে গাজীপুরের মাওনায় একটি চার্চে তাকে সমাহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণখান থানার ওসি (তদন্ত) আজিজুল হক মিয়া৷
ফেরানো বা সমাহিত করার উপায়
বছরের পর বছর বিদেশিদের লাশ মেডিকেলের মর্গে পড়ে আছে৷ কিভাবে এর সুরাহা হতে পারে? আইনে কী বলে? এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ নুরুল হুদা বলেন, ‘‘যে কোনো মামলা বা জিডির ভিত্তিতেই লাশ মর্গে পাঠানো হয়৷ ওই মামলাটির নিষ্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে লাশের বিষয়েও সুরাহা হয়ে যাওয়ার কথা৷ কোনো ক্ষেত্রে যদি সেটা না হয় তাহলে বুঝতে হবে, বিচারকের এখতিয়ারের বাইরে৷ সেখানে সরকারকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে৷ একটি লাশ তো মর্গে অনন্তকাল পড়ে থাকতে পারে না৷ তবে কেউ চাইলে জনস্বার্থে হাইকোর্টে যেতে পারেন৷ আমাদের দেশে আইনে যদি কোনো ব্যাখা না পাওয়া যায় সেখানে হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেন৷’’
পুলিশ কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিষয়টি যদি বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে, তাহলে আদালত থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে৷ পুলিশ এখানে কোনো ভূমিকা নিতে পারবে না৷ তাছাড়া লাশটি যার হেফাজতে আছে, সেই কর্তৃপক্ষও আদালতের কাছে সিদ্ধান্ত চাইতে পারেন৷ কারণ, এটা নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই৷’’
আইনে কী আছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট দেশ যদি রেসপন্স না করে, তাহলে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ি তিনি যে ধর্মের, সেই ধর্ম অনুযায়ী লাশ দাফন করা যেতে পারে৷ বছরের পর বছর তো সংরক্ষন করা সম্ভব নয়৷ এখানে তো অর্থের অপচয়ও হচ্ছে৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সিদ্ধান্ত চাইতে পারে৷ তারা যদি সিদ্ধান্ত না দেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে ধর্মের সেই ধর্মের মানুষ দিয়ে দাফন করানো যেতে পারে৷’’
তবে ঢাকা জজ কোর্টে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মর্গে যেসব লাশ আছে, সেই লাশগুলোর ব্যাপারে মামলা নিষ্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে বিচারক সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন৷ যদি কোনো ক্ষেত্রে বিচারকের এক্তিয়ারের মধ্যে না থাকে, সে কথাও কিন্তু বিচারক বলে দেন৷ তখন সিদ্ধান্তটি সরকারের তরফ থেকে আসতে হবে৷’’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সাবেক প্রধান,বর্তমানে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মর্গে কোনো লাশ থাকলে যে কর্তৃপক্ষ এনেছে, সেই কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দেওয়া ছাড়া ফরেনসিক বিভাগের আর কিছুই করার নেই৷ সেই কর্তৃপক্ষ যদি সাড়া না দেয় তারপরও লাশ হস্তান্তরের কোনো সুযোগ ফরেনসিক বিভাগ নিতে পারে না৷ যত কষ্টই হোক বা যত দিন লাগুক, লাশ রাখতেই হবে৷ যারা এনেছে, অর্থাৎ পুলিশ বা জেল কর্তৃপক্ষ তাদের আমরা বলতে পারি, লিখতে পারি৷ এর বাইরে আমাদের হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই৷’’