নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বাংলায় ধুন্ধুমার বিতর্ক
৯ আগস্ট ২০১৮অসমের নাগরিক পঞ্জীকরণের প্রক্রিয়ায় ৪০ লক্ষ মানুষকে অ-ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ তথাকথিত এই অনুপ্রবেশকারীদের ভবিষ্যৎ কী হবে জানা নেই৷ তারপরও বিষয়টি ভারতীয় রাজনীতিকে আলোড়িত করে তুলেছে৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সংক্রান্ত রাজনৈতিক গতিবিধির নেতৃত্বে রয়েছেন৷ অসমের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে৷ এখানেও বাংলাদেশ থেকে বহু ঢুকে পড়েছেন, এই অভিযোগ নতুন নয়৷ কিন্তু অসমের পঞ্জীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে তা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে৷ এই বিতর্কেরই সুযোগ নিতে চাইছে বিজেপি৷
৩১ জুলাই অসমের নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হওয়ার পর বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের দলের সরকার ক্ষমতায় এলে একইভাবে অবৈধ ভাবে বসবাসকারীদের চিহ্নিত করা হবে৷ তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক৷ পালটা হুংকার ছেড়েছে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস৷ তাদের কটাক্ষ, বিজেপি এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসবেই না৷ তাই এটা দিলীপ ঘোষের দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়৷
রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসার এখনই কোনো সম্ভাবনা নেই, এমনটা বিরোধীরা বলতেই পারে৷ কিন্তু যদি ধরেও নেওয়া যায় যে বিজেপি ক্ষমতায় এলো, তাহলে কি পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হবে? এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘নাগরিকপঞ্জি করা হয়েছে বহুবছর আগের একটা চুক্তির পরিণতিতে৷ প্রাক্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী যে চুক্তি করেছিলেন অসমের সঙ্গে, তারই ফলশ্রুতিতে আজকের এই নাগরিকপঞ্জি৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ তাকে ত্বরাণ্বিত করেছে৷''
এ কারণেই দিলীপ ঘোষের বক্তব্যে বা হুংকারে সারবত্তা পাচ্ছেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা৷ অধ্যাপক বলেন, ‘‘চুক্তি বা আদালতের নির্দেশ ছাড়া নাগরিকপঞ্জি করতে গেলে তো দলীয় স্তরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ বিজেপি সর্বভারতীয় দল, তাই রাজ্য নেতৃত্ব একতরফাভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না৷ সিদ্ধান্ত হবে কেন্দ্রীয় স্তরে৷ সেক্ষেত্রে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, নাগরিকপঞ্জি অন্য রাজ্যেও করতে হবে৷''
তাহলে কি দিলীপ ঘোষের স্লোগান একেবারেই রাজনৈতিক? এমনটাই মনে করছেন বাংলা পক্ষ নামক সংগঠনের নেতা, অধ্যাপক গর্গ চট্টোপাধ্যায়৷ পশ্চিমবঙ্গে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ঢুকে পড়েছে, বিজেপির এই দাবিকে পালটা যুক্তি হাজির করে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভারতে ১০ বছর অন্তর যে জনগণনা হয়, তার পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে, সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাভাষীদের সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি৷ বরং বাংলাভাষীদের সংখ্যা কমেছে৷ তাহলে অনুপ্রবেশের কথা বলা হচ্ছে কেন?''
এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণটাও ব্যাখা করেছেন বাংলা পক্ষের এই নেতা৷ গর্গের কথায়, ‘‘বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা চলে এলে তার পছেন রাজনৈতির কারণ থাকে৷ কিন্তু মুসলিমরা এলে ধরে নিতে হবে আর্থিক প্রয়োজনে এই অনুপ্রবেশ৷ অথচ পরিসংখ্যান বলছে, অসম বা বাংলার থেকে বাংলাদেশে মাথা পিছু আয় বেশি৷ সে জন্যই রুটিরুজির টানে বাংলাদেশিরা এখানে আসছে, এটা ঠিক নয়৷''
বিজেপি নেতৃত্ব বরাবরই অভিযোগ করেছেন, অসমের মতো বাংলাতেও দলে দলে বাংলাদেশি এ রাজ্যে ঢুকে পড়েছে৷ প্রয়াত বিজেপি নেতা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তপন শিকদার অনেক বছর আগে এ ধরনের মত ব্যক্ত করেছিলেন, যখন বিজেপি এখানে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠেনি৷ রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নাগরিকপঞ্জি বিজেপির কাছে শাঁখের করাত হয়ে উঠতে পারে৷ অসমে যে ৪০ লক্ষ মানু্য অ-ভারতীয় বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার একাংশ হিন্দু৷ তাঁদেরও কি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে? এ ব্যাপারে বিজেপির অবস্থানেও বিরোধাভাস রয়েছে৷ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা শরণার্থী৷ কিন্তু মুসলিমরা অনুপ্রবেশকারী৷
শীর্য বিজেপি নেতার এই বক্তব্যে তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়েছে বলে মত গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী দল, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি৷ হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান বিজেপির অ্যাজেন্ডা৷ তারা বাঙালিবিরোধী একটি দল৷ সে কারণেই বাংলাদেশি ছাপ্পা মেরে ভারত থেকে বাঙালিদের তাড়াতে চাইছে৷''
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘অ-ভারতীয় বাছতে গিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন করতে চাওয়া সাম্প্রদায়িক ভাবনা৷ এর একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে৷ কিন্তু আদতে অভিবাসন দক্ষিণ এশিয়ারই সমস্যা৷ এখানে অসম বা বাংলাকে আলাদা করে দেখলে হবে না৷ এটা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে উঠতে পারে৷''
এই স্লোগান কি বাংলার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে স্পর্শ করবে, করলেও কতটা তার ব্যাপ্তি হবে, এই প্রশ্নেই অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী লোকসভা ভোটের ফলাফল৷ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন এই ইস্যুতে৷ পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার শুরু করেছে৷ রাজনৈতিক হোর্ডিং দেখা যাচ্ছে কলকাতার রাস্তায়, হচ্ছে মিছিল৷ রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাম-ডানের মধ্যে তুমুল লড়াই, হিংসার ছবি দেখা গেলেও তাতে কোনো ধর্মীয় রং থাকত না৷ সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ রাজ্যের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে কিনা, তার জবাব মিলবে লোকসভা নির্বাচনে৷