1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ কী?

১৬ আগস্ট ২০১৯

ভারতের সংসদে জম্মু ও কাশ্মীরের মর্যাদা বদলের বিল পাশ হয়ে গেছে৷ অক্টোবর থেকে, একটি রাজ্যের পরিবর্তে সেখানে থাকবে দু'টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল৷

https://p.dw.com/p/3NzKF
Indien Kaschmir-Konflikt
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Yasin

ভারতের রাজ্যসভায় জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধানপ্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা সরানোর প্রস্তাব রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ৷ রাজ্যসভায় পাশ হবার পর লোকসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে পাশ হয়ে গিয়েছে বিলটি৷ ফলে, অক্টোবর থেকেই এই জম্মু ও কাশ্মীর হারাবে রাজ্যের মান৷ পরিবর্তে, ‘লাদাখ' ও ‘জম্মু ও কাশ্মীর' নামে দু'টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করা হবে৷ এই সাংবিধানিক মর্যাদা পরিবর্তন আনতে সরানো হয়েছে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ৷ কিন্তু একই সাথে রদ করে হয়েছে সংবিধানের ৩৫এ অনুচ্ছেদও৷

উল্লেখ্য, অনুচ্ছেদ ৩৭০ যখন একদিকে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য হিসাবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল, অন্যদিকে, অনুচ্ছেদ ৩৫এ বলা হয় জম্মু ও কাশ্মীরে ‘স্থায়ী বাসিন্দা'দের অধিকারের কথা৷ জমি ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তির কেনাবেচা, নির্বাচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করেছিল এই অনুচ্ছেদটি৷ শুধু তাই নয়,  জম্মু ও কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা কোনো নারী কোনো অস্থায়ী বাসিন্দা বা বহিরাগত পুরুষকে বিয়ে করলে কাশ্মীরস্থিত সম্পত্তির ওপর অধিকার হারাবেন, এমনও বলা ছিল সেই অনুচ্ছেদে৷

জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই পদক্ষেপকে দেখিয়েছেন উন্নয়নের সূচক হিসাবে৷ কিন্তু বিরোধী দলগুলির মধ্য থেকে উঠছে এই পদক্ষেপের বহুমাত্রিক সমালোচনা৷

ফলে, অনুচ্ছেদ ৩৭০ ও ৩৫এ সরানোর ফলে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা মতের৷ কিন্তু আসলে এই সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে কোন পথের হাঁটবে আগামীর কাশ্মীর?

Karte Grenzgebiete Kaschmir EN

তবুও বদলালো না যা...

৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যসভায় ৪০ পাতার ‘জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল' পেশ করেন৷ বর্তমানে সেই বিল পেশ হয়ে বাস্তবায়নের পথে৷ উল্লেখ্য, এই বিল পাশ হওয়ার ফলে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা হারিয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর৷ এর সাথে, কেন্দ্রশাসিত লাদাখে থাকবে না কোনো নির্বাচিত বিধানসভা৷ অন্যদিকে, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিদের কবলে থাকা জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে সেখানেও কেন্দ্রীয় শাসনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে, জানিয়েছেন অমিত শাহ৷

কিন্তু, সাধারণ জনতার ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বহু তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে মজুত থাকলেও সেনাবাহিনীকে সর্বাধিক ক্ষমতা প্রদানকারী ‘আফস্পা' বা ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়াস অ্যাক্ট' থাকছে অপরিবর্তিত৷ উল্লেখ্য, এই বিশেষ অ্যাক্টের সুযোগ নিয়ে কাশ্মীরসহ ভারতের একাধিক রাজ্যে সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে, এমন উদাহরণ প্রচুর৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনিপুরে মনোরমা ধর্ষণ কাণ্ড৷ এবিষয়েই ২০১৭ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ সেখানে নানা উদাহরণ দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হলেও সরকার সেই প্রতিবেদনের সত্যতা অস্বীকার করে৷ এবিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর ভারতীয় প্রধান মীনাক্ষী গাঙ্গুলি একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘‘সরকারের দায় শুধু কাশ্মীরে নিরাপত্তা বজায় রাখার নয়, পাশাপাশি সাধারণ জনতার নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করাও৷''

অন্যদিকে, জনমতকে অগ্রাহ্য করে মর্যাদা বদলের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ জনতার ওপর, যার ফলে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাড়তে পারে ভারত-বিদ্বেষী চিন্তা৷ এমনটাই মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানী নীতিন পাই৷ একই মতামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভারতের একাংশে৷ কিন্তু অপরদিকে, মর্যাদা বদলের সুফল নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বেশি৷

কিন্তু কতটুকু বাস্তবিক সেই আলোচনা?

স্বাভাবিকতার পথে কাশ্মীর

নীতিন পাই নতুন দিল্লির তক্ষশিলা গবেষনা সমিতির প্রধান৷ কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বহু বছর ধরে গবেষণা চালাচ্ছেন তারা৷ সম্প্রতি একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন মর্যাদা বদল প্রসঙ্গে৷ কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিকতার দিকে হাঁটতে পারে কাশ্মীরের জনতা, তাই বলেছেন তিনি সেখানে৷

ভারতের বাকি অংশের সাথে কাশ্মীরের জনতাকে একাত্ম করতে গেলে প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক সমাধানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমাধানও, বলেন পাই৷ স্থানীয় তরুণদের জন্য জীবিকা, ব্যবসার জন্য লগ্নির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি৷

৩৭০ ধারা বিষয়ে দুই দশক ধরে গবেষনা করে আসা আইনজীবী এ জি নুরানিও বিশ্বাস করেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমাধানে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ‘পুনর্গঠন বিল' এর বয়ান৷ সংবাদসংস্থা ‘দ্য ওয়্যার'-এ প্রকাশিত একটি মতামতে তিনি উল্লেখ করেন নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রাজ্য সিভিল সার্ভিস রদ করার কথা৷ তাঁর মতে, রাজ্যস্তরে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করার প্রক্রিয়া আক্রান্ত হচ্ছে এর ফলে৷ এই প্রেক্ষিতে, আঘাতপ্রাপ্ত হবে ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞায় কাশ্মীরী জনতার স্বাভাবিক অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়াও৷

স্বাভাবিক আগামীর জন্য পরামর্শ হিসাবে নুরানি আহ্বান জানাচ্ছেন মেহবুবা মুফতি, শাহ ফয়সাল ও ওমর আবদুল্লাহর মতো স্থানীয় নেতৃত্বকে একসাথে ‘যৌথ কাশ্মীর' আন্দোলন গড়ে তুলতে, যাতে করে মর্যাদা কমানো সত্ত্বেও কাশ্মীরের স্থানীয় মতামত জাতীয় মঞ্চে পৌঁছে দেওয়া যায়৷

উল্টোদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হিন্দি, তামিল ও তেলুগু ভাষার চলচ্চিত্র প্রযোজক সংস্থাদের উৎসাহ দেখিয়েছেন কাশ্মীরে লগ্নি করতে৷ ইতিমধ্যে, ভারতের সবচেয়ে বিত্তশালী ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানি একটি সংবাদ সম্মেলনে কথা দিয়েছেন কাশ্মীরে বিশাল অঙ্কের লগ্নি করার৷

কিন্তু এসবের পরেও, কাশ্মীরকে স্বাভাবিক করে তুলতে অর্থনৈতিক সমাধানের বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে৷ সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে রুখতে কতটুকু সফল হবে অর্থনৈতিক সমাধানের পথ, সেই বিবেচনাও সময়সাপেক্ষ৷

কেমন হতে পারে এই বদলের প্রভাব?

এরই মধ্যে, ভারতের এই মর্যাদা বদলের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক ইস্যুর আকার ধারন করেছে৷ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এবিষয়ে আলোচনা করার যে প্রস্তাব পাকিস্তান করেছিল, তা গ্রহণ করা হয়েছে ভোটাভুটির মাধ্যমে৷ পাকিস্তান ছাড়াও, আফগানিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও যুক্তরাজ্যের একাধিক রাজনীতিকরা এবিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন৷ ফলে, আন্তর্জাতিক মহলে আবার আলোচনায় কাশ্মীর৷

অন্যদিকে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কমানোর পর মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ভারতের অভ্যন্তরে একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন৷ বোড়োল্যান্ড, গোর্খাল্যান্ড, নাগাল্যান্ডসহ আরো কয়েকটি আন্দোলনের নেতৃত্বরা প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছেন এই বিলের৷ স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে, ভারতের স্বাধীনতা দিবস, ১৫ আগস্টে, নাগাল্যান্ডে ওড়ানো হয় স্বাধীন নাগাল্যান্ডের পতাকাও৷

ফলে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বদলের এই পদক্ষেপ ভারতের জন্য শুধুই আন্তর্জাতিক মহলে নয়, চাপ সৃষ্টি করছে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক বা দেশের ভেতরে আঞ্চলিক স্তরেও৷