মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে জড়িত এক চক্র
২২ জুন ২০১৮শুক্রবার মালয়েশিয়ার ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টার-এর অনলাইন সংস্করণে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই খবর ছাপা হয়েছে৷ সংবাদে এই চক্রের হোতা হিসেবে বাংলাদেশের মন্ত্রী মর্যাদার একজন ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিবেদনে তাঁর নাম প্রকাশ না করে আরো বলা হয়, ওই ব্যক্তির বয়স ৫০ বছরের মতো এবং তিনি ১৫ বছর আগে এক মালয়েশীয় নারীকে বিয়ে করেন৷
পত্রিকাটির খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে ২০১৬ সালে একটি চুক্তি সই হয়৷ ওই চুক্তির অধীনে সরকারে বাইরেও শ্রমিক নিয়োগের জন্য ১০টি কোম্পানিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷ এর আগে সরকারই কেবল জনশক্তি পাঠাতে পারতো৷ ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণেই চুক্তি সই হয়৷ তাঁর ছত্রছায়ায়ই এই ১০টি রিক্রুটিং কোম্পানি রাতারাতি গজিয়ে ওঠৈ৷ হাজার কোটি টাকার এই মানবপাচার ব্যবসাকে ‘বৈধতা’ দেওয়ার পেছনে তাঁর ভূমিকাই প্রধান৷
থাইল্যান্ডের ইংরেজি দৈনিকটির খবর অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যই এসব কোম্পানি গড়ে তোলা হয়৷ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার এই কেলেঙ্কারিকে নতুন ধাপে নিয়ে গেছেন এই মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তি৷
শ্রমিক পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াকে সহজ করতে এবং ১০টি কোম্পানির স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে এসপিপিএ নামে অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে৷ বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই নিবন্ধন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে হয়৷ এসপিপিএ অনুসারে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগে মালয়েশীয় কোম্পানিকে ৩০৫ রিঙ্গিত দিতে হয়৷ এই নিবন্ধন ব্যবস্থা পরিচালনা করে বেস্টিনেট এসডিএন বিএইচডি নামের একটি বেসরকারি কোম্পানি৷ এসপিপিএ-র সংগৃহীত অর্থ চলে যায় বেস্টিনেটের কাছে৷ ১০টি কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়োগকর্তাদের কাছে শ্রমিকদের বণ্টন কাজের জন্য এই অর্থ নেয় বেস্টিনেট৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া যেতে ওই দেশগুলোর শ্রমিকদের বাংলাদেশের তুলনায় কম টাকা দিতে হয়৷ ওই দেশগুলোর শ্রমিকদের খরচ পড়ে আড়াই হাজার রিঙ্গিতের মতো৷
ক্লাং ভ্যালিতে বেশ কয়েকটি কোম্পানির কনসালটেন্সি করা একটি কোম্পানির মালিক চিরারা কান্নান দ্য স্টার অনলাইনকে জানান, এসপিপিএ চালু হওয়ার আগে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগের খরচ ছিল অনেক কম৷ আগে শ্রমিকদের ৭ থেকে ৮ হাজার রিঙ্গিত দিতে হতো মালয়েশিয়ায় কাজের জন্য৷ কিন্তু এখন মধ্যস্থকারীরা বড় অংকের টাকা নেয় শ্রমিকদের কাছ থেকে৷
চিরারা জানান, বাংলাদেশের স্থানীয় গ্রামীণ এলাকার সাব-এজেন্টদের শ্রমিকরা দেয় ২০ হাজার রিঙ্গিত৷ এই সাব-এজেন্টরা আরো অন্তত দু'জন মধ্যস্থতাকারী মাধ্যমে সরকারের অনুমোদিত এজেন্টের কাছে যায়৷ আগে যারা সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্ট ছিল, তারা এখন বড় ১০টি কোম্পানির সাব-এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে৷
চিরারা বলেন, পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে৷ অনেক নিয়োগদাতা কোম্পানিও শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে৷ নিয়োগকৃত প্রত্যেক বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকে অনেক নিয়োগদাতা ১৫০০ রিঙ্গিত করে নিচ্ছেন৷ এসব কারণে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ ব্যবস্থাটি কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন চিরারা৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে পরিচালিত একটি মানবপাচারচক্র মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের কাজ দিয়ে মাত্র দুই বছরে ২০০ কোটি মালয়েশীয় রিঙ্গিত হাতিয়ে নিয়েছে৷ বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা৷ দ্য স্টারের দাবি, তাদের তদন্তে দেখা গেছে, বাংলাদেশের এজেন্টকে ১ লাখেরও বেশি শ্রমিক প্রত্যেকে ২০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত দিয়েছে৷ এই টাকার অর্ধেক স্থানীয় এজেন্ট ‘ওয়ার্ক পারমিট’ অনুমোদন ও মালয়েশিয়ায় বিমান টিকিটে ব্যয় করেছে৷ ২০১৬ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ১ লাখের বেশি শ্রমিক মালয়েশিয়া কাজের জন্য গিয়েছেন৷ এছাড়া আরও লক্ষাধিক শ্রমিক দেশটিতে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন৷ শ্রমিকদের কাছ থেকে ২০ হাজার রিঙ্গিত নিলেও মালয়েশিয়ায় একজন শ্রমিক পাঠানোর নথিভুক্তি ও পরিবহনে খরচ হয় ২ হাজার রিঙ্গিতের চেয়ে কম৷
দ্য স্টার জানায়, অর্থ হাতিয়ে নিয়ে ওই ব্যক্তি ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ ও সহযোগী ব্যবসায়ীরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন৷ তিনি শ্রমিকদের কাছ থেকে নেয়া টাকার কিছু অংশ উভয় দেশের রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের দেন৷
এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি'র কাছে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এসব বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই৷’’ মালয়েশিয়ার সংবাদ মাধ্যমের রেফারেন্স দিলেও তিনি একই জবাব দেন৷
এদিকে স্টার অনলাইনের আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় ১০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী পঠানোর প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে৷ সেখানকার মানবসম্পদমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে এই খবর দেয়া হয়৷ আর কারণ হিসেবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে৷ এ সম্পর্কে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরাও সংবাদ মাধ্যমে খবরটি দেখেছি৷ তবে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি৷ জানানো হলে পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা যাবে৷ তবে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে৷’’
এসব বিষয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এসব বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই৷’’ মালয়েশিয়ার সংবাদ মাধ্যমের রেফারেন্স দিলেও তিনি একই জবাব দেন৷
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘‘জি-টু প্লাস মানে হলো সরকারের সঙ্গে আরো ১০টি প্রতিষ্ঠানকে দুই বছর আগে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ দেয়া হয়৷ আর কাউকে সুযোগ দেয়া হয়নি৷ চুক্তিতে ছিল ৩৫-৪০ হাজার টাকায় তারা মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাবে৷ কিন্তু অভিযোগ আছে তারা নিয়েছে সাড়ে তিন-চার লাখ টাকা৷ এটা কিভাবে নেয়া হয়েছে তা তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার৷ শুধু তাই নয়, শুধু ১০টি কোম্পানিকে এই সুযোগ দিয়ে বাকি রিক্রুটিং কোম্পানিকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু বেশি টাকাই নেয়া হয়নি, শ্রমিকদের যে সুযোগ সুবিধা ও বেতনের কথা বলা হয়েছে, তা-ও তাঁরা পাননি৷ তাঁরা যে টাকা খরচ করে গেছেন, সেই টাকা তুলতে পারেননি৷’’
হাসান আহমেদ বলেন, ‘‘শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া এই চার-সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল? তা কি দেশের বাইরে পাচার হয়েছে? এনিয়েও তদন্ত প্রয়োজন৷’’