মোবাইল থেকে রাজস্ব বাড়ানো কঠিন
১২ জুন ২০২০মোবাইল অপারেটর রবি’র চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারের এই চেষ্টা সফল না-ও হতে পারে৷ উল্টো রাজস্ব কমে যেতে পারে৷ কারণ, মানুষ যদি আতঙ্কিত হয় যে, কথা বললে বেশি টাকা কাটবে তাহলে সে অবশ্যই কথা বলা কমিয়ে দিতে পারে৷ আমাদের আগের অভিজ্ঞতাগুলো এমনই৷ আগে সে ১০০ টাকা ব্যবহার করলেও এখন এই পরিস্থিতিতে টাকার অংশ কমেও যেতে পারে৷ আর যদি ১০০ টাকা ব্যবহার করেও তাতে তো সরকারের রাজস্ব বাড়বে না৷’’
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল৷ সেখানে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর গ্রাহক পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে৷ সব মিলিয়ে আগে যেটা ছিল ২৭ দশমিক ২৫ শতাংশ৷ এখন ৫ শতাংশ বৃদ্ধির পর সেটা দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ৷ এই ট্যাক্স বৃদ্ধির ফলে ১০০ টাকা রিচার্জে সরকারের কাছে কর হিসেবে যাবে ২৫ টাকার মতো৷ এতদিন তা ২২ টাকার মতো ছিল৷ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে এটা কার্যকর হয়ে গেছে৷
মোবাইল অপারেটররা হিসেব দিয়ে বলেছে, মানুষের মোবাইল ব্যবহার যদি একই থাকে তাহলে বছরে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব পাবে সরকার৷ তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপর৷
এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পক্ষে নন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘অপারেটররা যে হিসাব দিচ্ছে সেটা অমূলক নয়৷ বৃদ্ধি তো দূরে থাক, রাজস্ব কমেও যেতে পারে৷ করোনাকালীন এই সময়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে ইন্টারনেট৷ ফলে আমি কখনোই চাই না ইন্টারনেটের মূল্য বৃদ্ধি হোক৷ অর্থমন্ত্রী হয়তো তার কোনো পরিকল্পনা থেকে এটা করেছেন৷ টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো৷ তারপরও জাতীয় সংসদে তো আলোচনা হবেই৷’’
বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোবাইল সেবার ওপর ১ শতাংশ সারসার্জ আরোপ করা হয়৷ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরোপ হয় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ও ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক৷ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়৷ আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক আরো বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে৷ ২০২০-২১ অর্থবছরে এটা আরো ৫ শতাংশ বাড়ানো হলো৷
শীর্ষ দুই মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি'র হিসেবে, তাদের মোট রাজস্ব আয়ের ৫৩ থেকে ৫৬ শতাংশই সরকারের কোষাগারে বিভিন্ন কর ও ফি বা মাশুল হিসেবে চলে যায়৷ সাহেদ আলমের মতে, আগে শতকরা ২৮ টাকা তারা অপারেশন পরিচালনার জন্য খরচ করতেন৷ এখন ২৫ টাকা দিয়ে সেটা করতে হবে৷
টেলিকম বিশেষজ্ঞ ও একাধিক মোবাইল অপারেটরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা মেহবুব চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারের রাজস্বের দরকার আছে৷ করোনাকালীন সময়ে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান করতে হবে৷ কিন্তু হুট করেই এখানে শুল্ক বাড়ানো উচিত হয়নি৷ প্রয়োজনে এই সেক্টরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল৷ এখন মানুষ যদি ব্যবহার কমিয়ে দেয় তাহলে তো রাজস্ব কমে যেতে পারে৷ আর আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, তাহলে এখানে ইন্টারনেটের উপর অতিরিক্ত শুল্ক কেন৷ শুধু বড় অফিস নয়, ছোট-খাট অফিসগুলোও ইন্টারনেটের উপর ভিত্তি করে কার্যক্রম চলাচ্ছে৷ তাদের অপারেশন খরচ তো বাড়বে৷’’
মোবাইল সেবায় অতিরিক্ত শুল্কের খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ আলোচিত হচ্ছে৷ অনেকেই এটা নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন৷ আবু রাহাত খান নামে একজন শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘‘আমরা আবার ডাক বিভাগের চিঠির দিকে ফিরে যাই৷ কারণ, মোবাইলের পেছনে তো এত টাকা খরচ করা সম্ভব না৷’’ ওসমান গনি নামে একজন লিখেছেন, ‘‘চাইলেই পাবলিকের পকেট থেকে টাকা নেওয়া যায়, তাই এখানে প্রতি বছর ট্যাক্স বাড়ানো হয়৷’’ রুবিনা খনম নামে একজন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘‘একে তো করোনার জ্বালায় অতিষ্ঠ, তার উপর মোবাইলের খরচ বৃদ্ধি৷ পাবলিক যাবে কোথায়?’’ এমন অসংখ্য স্ট্যাটাস ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ সাধারণ মানুষ তাদের বিরক্তির কথা ফেসবুকে লিখছেন৷
গ্রামীণফোনের হেড অব পাবলিক অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত বলেছেন, ‘‘এই অতিরিক্ত শুল্ক গ্রাহকদেরই বহন করতে হবে৷’’ গ্রাহকদের স্বার্থে এ ধরনের সিদ্ধান্ত পুর্নবিবেচনার অনুরোধ করে তিনি বলেন, ‘‘এটা অবশ্যই ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অন্তরায়৷’’
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে৷ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)-এর সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল ওয়াহেদ তমাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনার সময়ে বাংলাদেশে অধিকাংশ কার্যক্রম ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে৷ সরকারও মানুষকে ঘরে থেকে অনলাইনে সবকিছু করতে উৎসাহিত করছে৷ অথচ ইন্টারনেটের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করা হচ্ছে৷ এই সিদ্ধান্ত দ্রুত গতিতে বিকাশ হওয়া অনলাইন মার্কেটের গতি শ্লথ করে দেবে৷ অনেকে ভয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করেও দিতে পারেন৷ যা ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে৷’’