ফেসবুক কি বাংলাদেশিদের বাকস্বাধীনতা হরণ করছে?
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরার পাশাপাশি উন্নয়নমূলক নানা কাজের কথা ফেসবুকে শেয়ার করেন নীল সালু (ছদ্মনাম)৷ কোন নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হলে তাঁর পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন৷ ফেসবুকে দেড় লাখের বেশি মানুষ সালুর ব্যক্তিগত প্রোফাইলটি অনুসরণ করেন৷ জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করলে এই সংখ্যাটা বেশ বড়৷
তবে সারা বছর একনাগাড়ে ফেসবুক ব্যবহার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না৷ মাঝেমাঝেই তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি ‘ডিস্যাবলড' হয়ে যায়৷ কেন এমনটা ঘটে? ডয়চে ভেলেকে নীল সালু বলেন, ‘‘আমি কখনোই একনাগাড়ে বারো মাস আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারিনি৷ যে কোনো কারণেই আমার অ্যাকাউন্টটি দুই থেকে তিন মাস বন্ধ মানে ‘ডিস্যাবল' থাকেই৷''
তিনি বলেন, ‘‘দেখা যাচ্ছে যে, ফেসবুকের কিছু স্প্যামিং গ্রুপ আছে, যে গ্রুপগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা হয়৷ এমনকি বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করে ফেক রিপোর্ট করা হয়৷''
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই বাসিন্দা মনে করেন, তাঁর বিভিন্ন পোস্ট এবং অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ক্রমাগত রিপোর্ট করে ফেসবুকভিত্তিক একটি চক্র৷ আর সেসব রিপোর্টের কারণে মাঝেমাঝে একাউন্টের নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি৷ শুধু তাই নয়, অতীতে আড়াই লাখ ফলোয়ারসহ একটি একাউন্ট চিরতরে হারিয়েছেন নীল সালু৷
ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হারিয়েছেন অনেকে
শুধু তিনি নন, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সাময়িক বা স্থায়ীভাবে হারানো মানুষের সংখ্যা অনেক৷ সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও বাংলাদেশে ২০ হাজারের বেশি ফেসবুক অনুসারী আছেন, এমন বেশ কয়েকজন অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদের এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে৷
সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট ফেসবুক প্রোফাইল সাময়িকভাবে হারান সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা৷ সরকারের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হিসেবে পরিচিত এই সাংবাদিক নিজের বাকস্বাধীনতা চর্চার অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমটি ব্যবহার করেন৷ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ তাঁর প্রোফাইল নিয়মিত অনুসরণ করেন৷
ঠিক কী কারণে ফেসবুক তাঁর প্রোফাইলটি ‘ডিঅ্যাক্টিভেট' করে দিয়েছিল, তা জানেন না মোর্তোজা৷ তবে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনে তাঁর ধারণা, ফেসবুক সম্ভবত কিছু বিষয় ‘বাংলাদেশ সরকারের চোখ' দিয়ে দেখতে চায়৷ ফলে একজন সাধারণ মানুষের নিজস্ব মতামত উপেক্ষিত হয়৷
অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিকদের পাশাপাশি রাজনীতিবদরাও মাঝেমাঝে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হারান বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সদস্য সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর৷ বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত এই রাজনীতিবিদ জানান, ঢাকায় স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ফেসবুকে বিভিন্ন গুজবের মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রোফাইল হারিয়েছেন তাঁর দলের অনেক নেতাকর্মী৷
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নিয়মিত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হারাচ্ছেন বলে জানান সূফি ফারুক৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা যেমন বিএনপি-জামাতের সমর্থকদের অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে হচ্ছে, আমাদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে৷ রোকেয়া প্রাচীর অ্যাকাউন্টটা কিছুদিন আগে ‘ডিঅ্যাক্টিভেট' হয়ে গেছে৷''
যেভাবে নিষিদ্ধ হচ্ছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমটি সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা মেনে চলে৷ দেশভেদে সেই নীতিমালায় কিছুটা ভেদাভেদ থাকলেও কেউ তা ভঙ্গ করলে তাকে বিভিন্নভাবে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা রেখেছে ফেসবুক৷ তবে প্ল্যাটফর্মটিতে কোন পোস্ট বা প্রোফাইল নীতিমালা ভঙ্গ করছে কিনা তা ফেসবুককে জানাতে ব্যবহার করা হয় প্লাটফর্মটিতে থাকা ‘রিপোর্ট' অপশন৷ যেকেউ এই অপশন ব্যবহার করে নীতিভঙ্গ বা আইন ভঙ্গের বিষয়গুলো ফেসবুককে জানাতে পারেন৷ আর তারপর ফেসবুক সেই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে কিংবা নীতি ভঙ্গ হয়নি মনে করলে কোনো ব্যবস্থা নেয় না৷
ফেসবুকের কর্মপন্থা প্রসঙ্গে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ রেজওয়ান ইসলাম বলেন, ‘‘ফেসবুকের মডারেশন সিস্টেম অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ংক্রিয়৷ সেখানে গালাগাল, বা বর্ণবাদ সংক্রান্ত কিছু নিষিদ্ধ ঘোষিত শব্দ দেয়া থাকে৷ সেগুলো নিয়ে রিপোর্ট করলে ফেসবুক অ্যাকশন নেয়৷''
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘যেমন রোহিঙ্গাদের নিয়ে বর্ণবাদী শব্দ ‘কালার' ফেসবুকের কাছে একটি নিষিদ্ধ শব্দ৷ এখন যদি আপনি একটি পোস্ট দেন এই বলে, ‘দেখেন বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের কালার বলছে৷' এখন কেউ যদি আপনার কণ্ঠরোধ করতে চায় বা হয়রানি করতে চায় তাহলে আপনার পোস্টের ‘কালার' শব্দটি উল্লেখ করে ফেসবুকের কাছে আপনার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে দেবে৷ আপনার পোস্টটি তখন হেট স্পিচ, হ্যারাসমেন্ট বা ভায়োলেন্স ছড়াচ্ছে বলে বিবেচিত হতে পারে এবং ফেসবুকের স্বয়ংক্রিয় ফিল্টারিং ব্যবস্থায় সেটি ধরা পরতে পারে৷''
রেজওয়ান বলেন, ‘‘এসব ক্ষেত্রে ফেসবুক সাধারণত যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে এক বা একাধিকবার সাবধান করে দেয় যে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘিত হচ্ছে৷ কিন্তু একসাথে বেশ কয়েকজন রিপোর্ট করলে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটি কন্টেক্সট বা বিষয়বস্তু বিবেচনা না করেই প্রোফাইল সাময়িক বন্ধ করে দেয়, বা সেই পোস্ট অন্যদের ফিডে আসে না৷ এছাড়াও এইসব পদক্ষেপ নেবার আগে ফেসবুক আপনার পূর্বের ইতিহাস দেখে, কারো বিরুদ্ধে যদি নিয়মিত রিপোর্ট হয়, বা ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বা অনেক ফলোয়ার ওয়ালা কেউ রিপোর্ট করে তাহলে আবার ব্যান হবার সম্ভাবনা বেশি৷''
ফেসবুক ব্যবহারকারী নীল সালু মনে করেন, ফেসবুকে বেশকিছু প্রাইভেট স্প্যামিং এবং হ্যাকিং গ্রুপ রয়েছে যেগুলোর একমাত্র কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট বা প্রোফাইলের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে রিপোর্ট করা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি, এসব গ্রুপের কেউ উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান, কেউ নেশাগ্রস্ত, কেউ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছেন, কেউ আছেন পরিবারের অবাধ্য সন্তান৷ তারা এ ধরনের স্প্যামিং, হ্যাকিং কিংবা অনলাইনে মেয়েদের ‘ব্ল্যাকমেইল' করার মতো কাজগুলো করে৷ এরা নিজেদের বীরত্বকে জাহির করতে এ ধরনের কাজ করে থাকে৷''
বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কোনো পোস্ট সম্পর্কে রিপোর্ট করা হলে, ফেসবুক তা কীভাবে পর্যালোচনা করে তা জানতে ডয়চে ভেলের তরফ থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়৷ জার্মানির হামবুর্গ শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় থেকে ক্লাউস গোর্নি ইমেলে জানান, বাংলাসহ বিশ্বের ৫০টির বেশি ভাষায় প্রকাশিত কন্টেন্ট মনিটর করতে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করছে ফেসবুকের ‘কন্টেন্ট রিভিউ টিম'৷ এই টিমে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের সদস্য রয়েছেন যারা সংশ্লিষ্ট ভাষা এবং দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন৷
ফেসবুকে একটি পোস্ট বা প্রোফাইলের বিরুদ্ধে যতবেশি মানুষ রিপোর্ট করবে সেটি মুছে ফেলার সম্ভাবনা তত বেশি বলে যে ধারণা রয়েছে, তা ঠিক নয় বলেও জানিয়েছেন গোর্নি৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা অনেকবার একটি কন্টেন্টের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা হলেও সেটি মুছে ফেলি না৷ বরং আমরা দেখি যে কন্টেন্টটি আমাদের নীতিমালা ভঙ্গ করছে কিনা৷ যদি না করে থাকে তাহলে সেটির বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর যত রিপোর্টই করা হোক, আমরা তা স্বয়ংক্রিয়াভাবে উপেক্ষা করি৷''
সরকারের কথায় ‘কন্টেন্ট সরায় না' ফেসবুক
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গণমাধ্যমকে জানান যে, ফেসবুক এখন সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের কথা শোনে৷ গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তাঁকে উদ্বৃত করা হয়েছে এভাবে, ‘‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে৷ ফেসবুক এখন আমাদের সঙ্গে এগ্রিড যে তারা স্থানীয় আইনকে (বাংলাদেশের) সম্মান করবে৷ কোনো লিংক যদি তা ভঙ্গ করে তাহলে তারা জানা মাত্রই ব্যবস্থা নেবে বা লিংক ব্লক করে দেবে৷''
সাম্প্রতিক এক ঘটনার উল্লেখ করে মন্ত্রী দাবি করেন, ‘‘এর মানে হলো, ধমক দিলে এখন ফেসবুক কাজ করে৷'' বাংলাদেশের বড় বাজার হারাতে চায় না বলেই ফেসবুকের সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছে বলেও মনে করেন এই টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী৷
সাময়িকভাবে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হারানোর পর তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে গোলাম মোর্তোজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফেসবুক যার অ্যাকাউন্ট তার বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে বাজার হারানোর ভয়ে সরকার যেটাকে বিভ্রান্তি বা গুজব বলছে, সেই সরকারের কথা শুনে বা বিশ্বাস করে সম্ভবত ফেসবুক আইডিগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে৷''
তবে ফেসবুকের কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স বিভাগে কর্মরত ক্লাউস গর্নি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের স্থানীয় আইন ভঙ্গ করছে, এমন অযুহাতে গত দু'বছরে কোন কন্টেন্টের উপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেনি ফেসবুক৷
তিনি লিখেছেন, ‘‘কোন কন্টেন্ট গোপন করা বা যাদের কাছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ তাদেরকে তা দেখতে বাধা দেয়া এককথায় ফেসবুকের আদর্শের পরিপন্থি৷'' বরং ফেসবুকের নীতিমালা জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা অনুমোদন করে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার ফেসবুক একাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধের কারণ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘‘ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিকে ভুল করে অন্য একজনের নামে তৈরি ফেক অ্যাকাউন্ট মনে করে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টি যাচাইয়ের পর আবার সেটি সক্রিয় করে দেয়া হয়েছে৷''
গোর্নি জানান, অন্যের নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়টি ফেসবুক একেবারেই সহ্য করে না এবং নানা পন্থা এ ধরনের অ্যাকাউন্ট শনাক্তে সহায়তা করে এবং সেগুলো বন্ধ করে দেয়৷ তবে প্রতি সপ্তাহে এ ধরনের লাখ লাখ রিপোর্ট যাচাইবাছাই করতে গিয়ে কখনো কখনো ভুল হয় বলেও স্বীকার করেছেন তিনি৷
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি৷ এই বিশাল জনগোষ্ঠী ফেসবুক ব্যবহার করলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এখনো অনলাইনে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট কোনো সংগঠন তৈরি করেনি বলে জানান সুফি ফারুকী৷ তবে, দলটির বিভিন্ন ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনলাইনে গুজব মোকাবিলায় সক্রিয় থাকতে বলা হয়েছে বলে জানান এই রাজনীতিবিদ৷