জাতীয় পার্টি ফ্যাক্টর!
১৪ জুলাই ২০১৭সম্প্রতি নতুন জোট গঠন করেছে জাতীয় পার্টি৷ গেল ৭ই মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ৫৮টি রাজনৈতিক দল নিয়ে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট' নামে এই জোটের ঘোষণা দেয় তারা৷ প্রাথমিকভাবে জাতীয় পার্টি ছাড়াও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ইসলামিক ফ্রন্ট, মাসখানেক আগে ৩৪টি ইসলামপন্থি সংগঠনকে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করা ‘জাতীয় ইসলামি মহাজোট' এবং ২০১৫ সালে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে পরে তাকেই অব্যাহতি দেওয়া ৩১ সংগঠনের ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট'ও রয়েছে এরশাদের এই নতুন জোটে৷
নতুন জোট গঠনের দিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেছেন, এই জোট তিনটি মৌলিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত৷ ইসলামি মূল্যবোধ, স্বাধীনতার চেতনা এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা মহাজোটের সঙ্গে ছিলাম৷ এখন নতুন জোট করছি৷ ভবিষ্যতে মহাজোটের সঙ্গে থাকব কিনা তা নতুন গঠিত জোট সিদ্ধান্ত নেবে৷ আগামী দিনে আমার দল ও জোটের সমর্থন ছাড়া কোনো দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না৷''
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখন জোটের রাজনীতির সংস্কৃতি চলছে৷ সেই ধারাবাহিকতাতেই তাঁদের এই প্রচেষ্টা বলে জানান তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘মূলত ১৯৯১ সালের পর জোটের রাজনীতি শুরু হয়৷ প্রথমে চার দলীয় জোট ৯৬-এ, পরে মহাজোট হয় ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর৷ আমরাও এবার আমাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জোটের একটি প্ল্যাটফর্ম করার চেষ্টা করছি৷''
এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামি ঐক্য ফ্রন্ট গড়ে ভোটে অংশ নিয়েছিলেন এরশাদ৷ ধর্মকে সবসময় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় এরশাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক আফসান চৌধুরী৷ ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের ব্যক্তিগত রেপুটেশন অনেক খারাপ৷ তাঁকে ‘বিশ্ববেহায়া' বলে বই পর্যন্ত লেখা হয়েছে৷ এটা নতুন কোনো কথা না৷ এমন চরিত্রের মানুষ ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করে কিভাবে?''
এদিকে, গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে, ঈদের পর বিশেষ দূতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে পারেন ‘আনপ্রেডিক্টেবল' এরশাদ৷ এমনকি কোনো কোনো গণমাধ্যম এমন প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে যে, জাতীয় পার্টির সদস্যরা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগও করতে পারেন৷ কিন্তু ঈদের এতদিন পরেও এ বিষয়ে টু শব্দটিও করছেন না কেউ৷ এ বিষয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলু ডয়চে ভেলেকে জানান, এগুলো প্রেসিডিয়াম সভায় আলোচনা হবে৷ সভা এখনো হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘বাজেট অধিবেশন চলছে৷ এছাড়া দেশে বন্যা হয়েছে৷ এসব নিয়ে এখন কাজ করছে জাতীয় পার্টি৷ সুতরাং এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়নি৷ প্রেসিডিয়াম সভা হলে সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে৷''
দলে কোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের আশঙ্কা উড়িযে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দলে কোন কোন্দল নেই৷ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা করছি আমরা৷ তাই দলের মধ্যে মতামত-দ্বিমত থাকতেই পারে৷'' এছাড়া দলের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে নেয়া হয় বলেও দাবি করেন তিনি৷ তবে বিভিন্ন সময়ে চেয়ারম্যান এরশাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই দ্বিমত প্রকাশ করেছেন দলের অনেক সিনিয়র নেতা৷ এমনকি দলটির অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদও একক কোনো সিদ্ধান্ত না নেবার জন্য এরশাদের প্রতি প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন৷ এই সংকট প্রকট হয় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়৷ এরশাদ প্রথমে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে থাকলেও শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন৷ কিন্তু রওশনপন্থিরা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে থাকেন এবং অংশ নেন৷ পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির তিনজন নেতাকে মন্ত্রিত্ব দেয়া হয় এবং নির্বাচন বর্জন করা এরশাদ পরবর্তীতে হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত৷
এরপর ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে আবারো রওশনপন্থি নেতাদের বিরাগভাজন হন এরশাদ৷ সে সময়ও দলে ভাঙ্গনের সুর বাজছিল৷ রওশনপন্থিরা বৈঠক করে রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দেন৷ তখনকার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন৷ এই সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত এরশাদ দ্রুত সংবাদ সম্মেলন করে বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে নতুন মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন৷ তবে বাস্তবতা হলো, জাতীয় পার্টির (এরশাদ ও রওশনপন্থি) দুই ‘অংশ' নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকলেও দল ভাঙ্গেনি৷ সেই সময়ের মহাসচিবের পদ হারানো বাবলু ডয়চে ভেলেকেও তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ এর পাশাপাশি অবশ্য এত প্রকট হয়ে ওঠা মতবিরোধকে ‘গণতান্ত্রিক চর্চা' বলে পাশ কাটানোর চেষ্টাও করেছেন তিনি৷ তাঁর মতে, ‘‘বড় বড় সব রাজনৈতিক দলেই মতবিরোধ থাকে৷ কিন্তু তা দলীয় সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব ফেলে না৷''
এখন প্রশ্ন হলো, নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির নতুন জোট কতটা প্রভাব ফেলবে মহাজোটের রাজনীতিতে? সম্প্রতি ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছেন যে, জাতীয় পার্টি এখন আর ‘গৃহপালিত বিরোধী দল' নয়৷ জাতীয় পার্টি সামনের সারির দল৷ বাবলু বলেন, ‘‘চলতি বাজেট অধিবেশনেই পল্লীবন্ধু হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদসহ আমরা বেশ কিছু প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেছি৷ আমাদের প্রতিবাদের কারণেই, সব পণ্যে ঢালাওভাবে ১৫% ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং স্বল্প আমানতকারীদের ওপর আবগারী শুল্ক কমানো হয়েছে৷ সুতরাং আমাদেরকে এখন আর সেভাবে (গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে) চিহ্নিত করা হয় না৷''
কোনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও তাদের জোট ১০০টি আসন চেয়েছে আওয়ামী লীগের কাছে৷ এর মধ্যে জাতীয় পার্টির ৭০টি এবং জোটের বাকিদের ৩০টি৷ তবে বাবলু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ সব হিসেব-নিকেষের সময় এখনো আসেনি৷'' তবে সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি৷
জোট গঠনের পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে কথা বলেন জাপা প্রধান এরশাদ৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘জাতীয় পার্টি এখন রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর৷ আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি প্রস্তুত৷ আমরা এখন ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি৷ মানুষের ভালোবাসা আছে, সরকারও গঠন করবে জাতীয় পার্টি৷''
তবে তাঁর এই বক্তব্যকে খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা৷ আফসান চৌধুরী মনে করেন না যে, আওয়ামী লীগের ভোটের হিসেব-নিকেষে, জাতীয় পার্টির খুব একটা ‘গুরুত্ব' আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় পার্টির রাজনীতি টিকে আছে আওয়ামী লীগের কল্যাণে৷ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বিষয়টি হলো, তারা দেখাবে যে, সংসদে একটি বিরোধী দল আছে৷ তাদের নামে মামলা হলেও তেমন হয়রানি হয়নি, যতটা বিএনপির ক্ষেত্রে হয়েছে৷ তারা তো নিশ্চিন্তে রাজনীতি করতে পারছে৷''
নতুন জোটও আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নিয়ে আসতে পারবে না বলে মত তাঁর, ‘‘এর আগেও জাতীয় পার্টি জোট করেছে৷ এর আগে আ স ম আবদুর রবও তো জোট করেছিলেন৷ এখন কোথায় তাঁর বা তাঁর দলের অবস্থান? আর জোট করতে হবে তেমন দল নিয়ে, যার বড় জনসমর্থন আছে৷ যেই দলগুলোকে নিয়ে ওরা জোট করেছে, তাতে আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কী যোগ করতে পেরেছে?''
এমনকি মহাজোটের অন্য শরীক দলগুলোও জোটের ভেতরের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়েও সংশয় প্রকাশ করেন আফসান চৌধুরী৷ তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ জোটের জন্য রাজনীতি করে না৷ নিজের জন্য করে৷'' তিনি মনে করেন, জাতীয় পার্টি যতই জোট করুক আর নিজেদের ‘বড় ফ্যাক্টর' বলে দাবি করুক, দেশের রাজনীতিতে তাদের জনসমর্থন খুব কম৷ তারা বড়জোর জোট করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ‘কিছু বেশি' আদায় করতে পারবে এবং এটাই তাদের উদ্দ্যেশ্য বলে মনে করেন তিনি৷ জোটের বামপন্থি অন্যান্য দলগুলোর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য বলে মনে করেন আফসান চৌধুরী৷